গুয়াহাটি, ২০ ফেব্রুয়ারি (হি.স.) : দিল্লির শ্রদ্ধা ও মুম্বাইয়ের আদলে গুয়াহাটিতে পরিকল্পিত জোড়া খুনের এক ঘটনায় অসম ছেড়ে চাঞ্চল্য চড়িয়েছে দেশ জুড়ে। প্রায় ছয়মাস আগে স্বামী অমরজ্যোতি দে এবং শাশুড়ি শংকরী দে-কে টুকরো টুকরো করে খুন করার পর তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল খুনি মহিলা। পরে সময়-সুযোগ করে দুজনের মৃতদেহ মেঘালয়ের দুই স্থান চেরাপুঞ্জি এবং ডাউকি পাহাড়ের গভীর খাদে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে খুনি বন্দনা কলিতা নামের অমরজ্যোতির যুবতী-স্ত্রী তথা শংকরী দের পুত্রবধূ বন্দনা কলিতাকে। সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে খুনে সহায়তাকারী খুনির প্রেমিক ধনজিৎ ডেকা এবং বন্ধু অরূপ দাসকে। ইতিমধ্যে মেঘালয় পুলিশের সহযোগিতায় দুটি মৃতদেহের কিছু অঙ্গ উদ্ধার করেছে অসম পুলিশ। গতকাল এবং আজ সকালেও সংশ্লিষ্ট দুই স্থানে মৃতদেহ অবশিষ্ট অঙ্গের সন্ধানে দুই রাজ্যের পুলিশ অভিযান চালিয়েছে।
লোমহর্ষক মর্মান্তিক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে গুয়াহাটি মহানগরীর নারেঙ্গি এবং চাঁদমারি এলাকায়। জনৈক মহিলা পরকীয়া এবং সম্পত্তি লোভে তার প্রেমিকের সাথে স্বামী ও শাশুড়িকে নৃশংসভাবে খুন করেছেন। মহিলাটি প্রথমে নুনমাটির ফ্ল্যাটে তার শাশুড়ি শংকরী দেকে খুন করে লাশ ফ্রিজে রাখে। এর তিনদিন পর চাঁদমারির ফ্ল্যাটে স্বামী অমরজ্যোতিকে কেটে তাঁর লাশও টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে রেখে পরেরদিন মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এবং ডাউকিতে পাহাড়ের খাদে ফেলে দেয়।
প্রায় ছয় মাস আগের ঘটনা কোনওভাবে প্রকাশ্য আসে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। ওই দিনই নুনমাটি থানার পুলিশ আটক করে বন্দনা কলিতাকে। পুলিশের কাছে জানা গেছে, নারাঙ্গির এসবিআই ব্যাংক সংলগ্ন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা শংকরী দের ছেলে অমরজ্যোতি ডেকা প্রায় দশ বছর আগে বন্দনা কলিতাকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের বিয়েতে সায় ছিল না অগাধ সম্পত্তির অধিকারিণী অমরের মা শংকরী দের। গুয়াহাটিতে তাঁর চার-পাঁচ তলা-বিশিষ্ট চার থেকে পাঁচটি ফ্ল্যাট আছে। ফ্ল্যাটগুলিতে আছেন বহু ভাড়াটে। সেই সুবাদে ব্যাংকে জমা আছে প্রচুর টাকা। ভাড়াটের টাকা তোলার দায়িত্ব শংকরী দে দিয়েছিলেন তাঁর ভাইকে। মামা-শ্বশুরকে কেন টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, এই প্রশ্ন তুলে নানা সময় প্রচণ্ড ক্ষেপে মারমুখি হয়ে যেতেন পুত্রবধূ। এদিকে অপছন্দের এই বিয়ের পর চাঁদমারির ফ্ল্যাট ছেলে অমরজ্যোতিকে দিয়ে দেন মা। ফলে ছেলে অমরজ্যোতি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে থাকতেন চাঁদমারিতে এবং মা শংকরী দে একা থাকতেন নারেঙ্গিতে এসবিআই সংলগ্ন ফ্যাটের তিনতলায়।
ভাড়াটেদের কাছে জানা গেছে, সম্পত্তি ও টাকা তার নামে লিখে দিতে এবং মামা কেন ভাড়ার টাকা সংগ্রহ করবেন, এ নিয়ে বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই বন্দনা নাকি নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে ঝগড়াঝাটি করতেন। কখনও কখনও রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফুলদানি বা অন্য সামগ্রী হাতে তুলে শাশুড়ি ও স্বামীর ওপর হামলা করতেন তিনি। মূলত সম্পত্তির ভাগ দাবি করে শাশুড়ি ও স্বামীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হত বন্দনা। এরই মধ্যে বন্দনার জীবনে প্রবেশ করে ধনজিৎ ডেকা নামের এক যুবক। ভাড়াটেরা জানান, গত বছর সংগঠিত ঘটনার দিন বা তার পর কিছুই টের পাননি তাঁরা। স্বামী অমরজ্যোতি এবং শাশুড়িকে দেখা যাচ্ছে না, তাঁরা কোথায় জানতে চাইলে বন্দনা নাকি বলতেন তাঁরা তীর্থভ্রমণে গিয়েছেন। তবে তাঁরা নিখোঁজ হওয়ার পর শংকরী দেবীর ফ্যাটে সব ভাড়াটে এবং অন্য আমন্ত্রিত অতিথির উপস্থিতিতে ঘটা করে সত্যনারায়ণ পুজো দিয়েছিলেন বন্দনা। অথচ ঘূণাক্ষরেও তাঁরা টের পাননি, যে ঘরে বন্দনা সত্যনারায়ণের পুজো দিচ্ছেন, সেই ঘরের ফ্রিজেই রাখা হয়েছে শাশুড়ি শংকরী দের টুকরো টুকরো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
আজ ঘটনাটি জানার পর প্রতিবেশী ভাড়েটেরা হতবাক হয়ে যান। তাঁরা বলেন, অভিযুক্ত বন্দনা কলিতা গত বছর বাড়ি পরিষ্কার করতে এসে তাকে ছাদে বিছানা এবং অন্যান্য জামাকাপড় পোড়াতে দেখেছিলেন।
নুনমাটি থানার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার জানান, নৃশংস শিহরণকারী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ছয়মাস আগে অৰ্থাৎ ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট সংগঠিত হয়েছিল। পুলিশ অফিসার জানান, অতি সম্প্রতি ব্যাংকের এটিএম কাউন্টার থেকে কেউ পাঁচ লক্ষ টাকা তুলেছে বলে অমরজ্যোতির মামার কাছে ধরা পড়ে। ব্যাংকে গিয়ে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, বন্দনা কলিতা পাঁচ লক্ষ টাকা তুলেছেন। এর ভিত্তিতে মামা-শ্বশুর নন্দিতা কলিতার বিরুদ্ধে নুনমাটি থানায় এফআইএর করেন। ওই এফআইআর-এর ভিত্তিতে গত শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) নন্দিতা কলিতাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে গোটা ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়, জানান তদন্তকারী পুলিশ অফিসার।
তিনি জানান, জিম ইনস্ট্রাক্টর নন্দিতা নাকি প্রথমে নারেঙ্গির ফ্ল্যাটে এবং তিনদিন পর স্বামী অমরজ্যোতিকে খুন করেছিল। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে গত দুদিন থেকে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এবং ডাউকি পুলিশের সহযোগিতায় দুটি মৃতদেহ কিছু অঙ্গ উদ্ধার করেছেন। দুটি মৃতদেহের মাথা, হাত পা-এর অংশ এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এগুলি আদৌ মিলবে কিনা, সন্দেহ ব্যক্ত করে পুলিশ অফিসার বলেন, এতদিনে মৃতদেহগুলি একে-তো পচেগলে একাকার হয়ে গেছে, দ্বিতীয়ত সম্ভবত পশু-পাখিও খেয়ে ফেলতে পারে, তাই বাকি অঙ্গ উদ্ধারে সংশয় রয়েছে। তবুও চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা, বলেন তিনি।
পুলিশের কাছে ধৃত নন্দিতার বয়ান, গত কয়েক মাস থেকে তিনি স্বামীর সঙ্গ ছেড়ে বাবার বাড়ি (গুয়াহাটিতে) চলে গিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে টাকা নিতে শাশুড়ি ও স্বামীর কাছে আসতেন। ইত্যবসরে তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের তোড়জোড় শুরু হয়। সেই প্রক্রিয়া চলছিলও। তবে ঘটনার দিন তিনি শাশুড়ির কাছে এসে সম্পত্তি তাঁর নামে লিখে দিতে চাপ দেন। শাশুড়ি রাজি না হওয়ায় তিনি তাঁর দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শাশুড়িকে মেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু ঘটে। ফলে শাশুড়ির হাত-পা কেটে ফ্রিজে রেখে দেন তারা। এর পর চলে যান স্বামী অমরজ্যোতির ফ্ল্যাটে।
সেখানে তিনদিন পর অমরজ্যোতির মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। কিন্তু মৃত্যু না হওয়ায় জীবন্ত তাঁর হাত ও পা কেটে খুন করেন বন্দনা, তার প্রেমিক ও বন্ধু। তাঁর মৃতদেহও ফ্রিজে রাখে তিন খুনি। এর পর ২১ আগস্ট (২০২২) দুটি চার চাকার গাড়িতে করে দুটি মৃতদেহ মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এবং ডাউকির পাহাড় থেকে খাদে ফেলে দেয় তারা। দুই গাড়ির একটি এএস ০১ জেসি ৫৭৯৫ নম্বরের হোন্ডাই কার উজান অসমের তিনসুকিয়া থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
তিনি জানান, পরিকল্পিত জোড়া খুনের কয়েক মাস পর নন্দিতা তার স্বামী অমরজ্যোতি দে এবং শাশুড়ি শংকরী দে নিখোঁজ বলে এক এফআইআর নুনমাটি থানায় করেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে পেশাধারী খুনিকেও হার মানাবে বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পুলিশ অফিসার। তিনি জানান, গতকাল রাতে বন্দনাকে পানবাজার মহিলা থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুজনকে রাখা হয়েছে নুনমাটি থানায়। আজ তিনজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে আদালতে তোলা হবে। আদালতে দু-তিন সপ্তাহের রিমান্ড চাইবেন তাঁরা, জানান পুলিশ অফিসার।
এদিকে স্বামী ও শাশুড়িকে খুন এবং পরবর্তীতে তাদের মৃতদেহ মেঘালয়ের পাহাড়ি খাদে ফেলা, যাবতীয় ঘটনা তার বাবা জানতেন বলে নাকি বয়ান দিয়েছেন খুনি বন্দনা কলিতা। তবে ঘটনার কিছুই তিনি জানতেন না বলে আজ সংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন বন্দনার বাবা। তিনি বলেন, মেয়ের কথায় তিনি ঘটনার পর অভিশপ্ত ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। মেয়ের সঙ্গে ঘরে সাফাই কাজে সহায়তা করেছেন ঠিক, কিন্তু তিনি মোটেও ভাবেননি এখানে খুনের ঘটনা ঘটেছে। বন্দনা যদি সত্যিই শংকরী দে এবং অমরজ্যোতিকে খুন করে থাকে তা-হলে তাকে গুলি করতে মেরে ফেলতে সাংবাদিকদের মাধ্যমে পুলিশের কাছে আবদার করেছেন তিনি।
বাবার বক্তব্য কতটা সত্য, তা তাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে, বলেছেন ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার। প্রসঙ্গত, অসমে এ ধরনের নৃশংস ঘটনা এই প্রথম।হিন্দুস্থান সমাচার / সমীপ / অরবিন্দ

