BRAKING NEWS

বেনারসে বাড়ছে দুর্গাপুজোর ব্যস্ততা, মিলবে এই বঙ্গের মতই পুজোর আমেজ

কলকাতা ১৩ সেপ্টেম্বর (হি. স.) : প্রাচীনতম জনপদগুলির অন্যতম কাশী। কথিত আছে দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূলের উপর অবস্থান কাশীর। এখানে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম বিশ্বনাথ মন্দির ছাড়াও অন্নপূর্ণা মন্দির দেখতে সারা পৃথিবী থেকেই লক্ষ লক্ষ পূর্ণার্থী আসেন কাশীধামে। সেই কাশী বা বারানসীর বাঙালিটোলায় বাড়ছে দুর্গাপুজোর ব্যস্ততা।

কাশী বা বারানসী শহরে প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি বাঙালি বসবাস করেন। তাই এখানে শিবের ঘরনি দুর্গা একটু বেশিই আদরযত্ন পাবেন সেটা বলাই বাহুল্য। তাই বেনারসে দুর্গাপুজোর চল একটু বেশি উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য শহরের থেকে। পুজোর সময় বেনারস বা বর্তমানে বারানসী স্টেশন থেকে গোধুলিয়া মোড়ের দিকে যত এগোবেন ততই আপনার বাঙালি স্বত্ত্বা জেগে উঠবে। কারণ, থেকে থেকেই ঢাকের বাদ্যি কানে আসবে। আর নাকে আসবে ধূপ, ধুনো, কর্পূর, ঘি মিশ্রিত সেই অপার্থিব গন্ধ।

কথিত আছে, ১৭৭৩ সালে বেনারসে বাঙালি রীতিতে দুর্গাপুজো শুরু করেন জমিদার আনন্দময় মিত্র। আবার ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নাটোরের রানি ভবানী দুর্গা কুণ্ড মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরের সঙ্গে যে কুণ্ড রয়েছে তা সরাসরি গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত। বারানসীর প্রাচীন দুর্গাপুজোর মধ্যে অন্যতম পাঁড়ে ধর্মশালার পুজো। এর পাশেই আছে হরসুন্দরী ধর্মশালা। গোধূলিয়া থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে মদনপুরা জঙ্গমবাড়ি। এই পুরাতন দুর্গাবাড়ীতে ১৭৬৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত মা দুর্গার মাটির মূর্তি আজও অমলিন। তাজ্জব ব্যাপার এই যে ২৫৪ বছর পরও মাটির তৈরি মা দুর্গার এই প্রতিমা যেমন ছিল তেমনই আছে বলে লোকের বিশ্বাস।

পাঁড়ে ধর্মশালা বা হরসুন্দরী ধর্মশালায় পুজোর কটা দিন বাঙালি খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ পাবেন। এই ধর্মশালাগুলিতে ঢুকলেই মনে হবে চলে এসেছেন ১৯ শতকের কোনও এক জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানে ঢুকে পড়েছেন। তিনদিক ঘেরা বারান্দা আর তার পিছনে ঘর, সেখানে মায়ের পুজো হচ্ছে। এছাড়া গোধূলিয়া থেকে দেড়-দুই কিমি দূরত্বে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো বা সিগরা-তে ভারত সেবাশ্রমের পুজোও দেখার মত। দুপুরে গেলে সেখানে চমৎকার ভোগ খাওয়ার সুযোগ মেলে।

গোটা বেনারস শহরে কম-বেশি ৩০০-টির মতো দুর্গাপুজো হয়। প্রাচীন এই শহরে একদিকে অবাঙালিরা যেমন নবরাত্রি পালন করেন, তখন বাঙালি সম্প্রদায় দুর্গাপুজো করেন। এখানে আজও থিমের পুজোর রমরমা নেই। পুজোয় যদি বেনারস ঘুরতে যান, তবে একটা জিনিস অবশ্যই চোখে পড়বে। দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে একটা আবেগ কাজ করে। ঘরের মেয়ে উমা চারদিনের জন্য এসেছে বাপেরবাড়ি, এমনটা বেনারসেও লক্ষ্য করা যায়। আর একটা বিষয়, এই শহরে কলাবউ বা নবপত্রিকাকে কিন্তু লালপাড় সাদা শাড়িতে দেখা যায় না। দেখা যায় বিশুদ্ধ বেনারসী শাড়িতে। এটাই এখানকার দুর্গাপুজোর মূল বৈশিষ্ট বলতে পারেন।

বেনারস থেকে ৬৩ কিমি দূরে বিন্ধ্যাচলে আছে অতি প্রাচীন দেবী বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির। গোধূলিয়া থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়, দরদাম করে নিতে হবে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দুর্গা সপ্তশতীতে উল্লেখ আছে মহিষাসুরকে বধ করার সময়ে দেবী অনেকগুলি রূপ ধারণ করেন, তার মধ্যে একটি হল দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। এখানেও দুর্গাপুজো হয় মহা ধুমধাম করে।

একটা সময় বিজয়া দশমীর বিকেলে বেনারসে ভারত সেবাশ্রমের সন্ন্যাসীদের লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, তরোয়াল নৃত্য দেখা যেত। শোভাযাত্রা করে দেবী প্রতিমা নিয়ে আসা হত ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাটে, তখনই সন্নাসীরা তাঁদের নানান কসরত দেখাতেন। এরপর মা দুর্গাকে বসানো হত সুসজ্জিত বজরায়। পাশেই দশাশ্বমেধ ঘাটে তখন আরেকটি বজরার উপর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিমা উপবিষ্টা। ঠিক সন্ধে ছটার সময় ঘাটে যখন গঙ্গারতি শুরু হত, তার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের বজরার উপর আশ্রম ও সংঘের সন্ন্যাসীরা করতেন প্রতিমা বিসর্জনের আরতি। আরতি শেষে বজরা এগিয়ে যেত মাঝনদীতে। শেষে প্রতিমা নিরঞ্জন সেখানেই। কালের নিয়মে এই রীতি এখন আর নেই। ২০১৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে গঙ্গাতে প্রতিমা বিসর্জন বন্ধ হয়ে গেছে।

বাঙালিটোলার কাছে গোল্ডেন স্পোর্টিং ক্লাবের বেনারসের বারোয়ারি পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানকার প্রতিমা সবচেয়ে বড়। আর এর শোভাযাত্রাও এক অন্য মাত্রা পায় গোটা বেনারসে। কদর রয়েছে কেদারনাথ মন্দিরের কাছে দুর্গাবাড়ির। শোনা যায় একবার ভাসানের সময় দেবী স্বপ্ন দেন তাঁকে বিসর্জন না দিয়ে সারা বছর শুধুমাত্র ছোলা-গুড় দিয়ে পুজো করলেই হবে। প্রায় আড়াইশো বছর এই প্রথা চলে আসছে। মাটি, খর, বাঁশ দিয়ে তৈরি এখানকার দুর্গাপ্রতিমা ২৫৪ বছরেও ক্ষয় হয়নি। বর্তমান জ্ঞান -বিজ্ঞানের যুগে, বেনারসের এই দুর্গাপ্রতিমা কোনও অলৌকিক ঘটনার থেকে কম নয়।

পুরাতন দুর্গাবাড়ীতে ১৭৬৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত মায়ের মৃন্ময় মূর্তিটি দেখে বিজ্ঞানীরাও হতবাক। ক্ষয় রোধে রাসায়নিক আবরণ বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই, তবুও বিস্ময়কর পাঁচ ফুটের মূর্তিটি আগের মতই রয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলির বাসিন্দা মুখোপাধ্যায় পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছিল। যেখানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, মূর্তিটি একই বেদীতে একইভাবে রয়ে গেছে। তৈলাক্ত রঙে গড়া দুর্গা মূর্তির সঙ্গে রয়েছে গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিকেয় এবং মহিষাসুর। তাই বারানসী পুজোর কয়েকটা দিন ঘুরে আসার আদর্শ স্থান। কখনই মনে হবে না আপনি বাংলার বাইরে রয়েছেন। চারিদিকে পুজো পুজো গন্ধ এবং ঢাকের আওয়াজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *