ভারতের অর্থনীতির সর্বনাশ চাইছে আইএসআই! প্রশিক্ষণ দিচ্ছে জালনোটের কারিগরদের

কিশোর সরকার

ঢাকা, ২৯ সেপ্টেম্বর (হি.স): ভারতের অর্থনীতিতে ধস নামাতে পাকিস্তানী গোয়েন্দ সংস্থা আইএসআই-এর নয়া অস্ত্র ‘জালনোট’। ভারতের মিত্র প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে জালনোটের কারিগরদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে আইএসআই। কখনও পাকিস্তানে তৈরি করে, কখনও আবার বাংলাদেশেই নিজস্ব কারিগর দিয়ে জালনোট তৈরি করে তা ভারতে পাঠানো হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রেই ধরা পড়ছে পাক গোয়েন্দ সংস্থার মদতপুষ্ট ভারতীয় জাল টাকার কারবারিরা। গ্রেফতার হলেও, কিছুদিন পরেই আবার জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসছেন জালনোটের কারিগররা। পর্দার আড়ালে ঠিক কে বা কারা রয়েছে, তা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের গোয়েন্দ সূত্রের খবর, পাক গোয়েন্দ সংস্থার তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান থেকে ছাপা হয়ে দুবাই, কাতার, আরবআমিরাত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা হয়ে বিমানে ঢাকায় আসছে জালনোট। আর বিমান যোগে ঢাকায় আসা পাকিস্তানের সেই জালনোট স্থল সীমান্ত দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ভারতে।

কিন্তু, করোনাভাইরাসের সময় যখন বিমান পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়, তখন থেকে বাংলাদেশেই প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরির চেষ্টা চলছে জালনোটের কারিগর। বিশেষ করে বাংলাদেশে যারা বাংলাদেশী জাল টাকা তৈরির সঙ্গে জড়িত তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ করার চেষ্টা চালাচ্ছে পাক গোয়েন্দ সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)। বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের মতে বিভিন্ন রুটে পাকিস্তান থেকে যে জালনোট বাংলাদেশে আসে তা ভারতীয় রুপির মতোই একই কাগজে একই রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে টাকা যে-সব অত্যাধুনিক মেশিনে ছাপানো হয় সেই ধরণের মেশিনেই ছাপা। তাই বিমান যোগে আসা ভারতীয় জালনোট দেখতে হুবহু ভারতের আসল টাকার মতো। যা অত্যাধুনিক মেশিন ছাড়া ভারতীয় এই জালনোট শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়র কবিরের মতে, ভারতীয় জালনোটের সঙ্গে পাকিস্তান তথা আইএসআই সরাসরি জড়িত। এমনকি ২০১৫ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনের কর্মকর্তার জঙ্গি অর্থায়ন ও ভারতীয় জাল রুপির কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। তবে করোনার কারণে বিমান পরিষেবা অনেকটা বন্ধ থাকায় জাল ভারতীয় রুপি তৈরির কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টা আইএসআই-এর নতুন কৌশল বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু যারা ভারতীয় জালনোট বানায় তারা বাংলাদেশের জাল টাকাও তৈরি করে। তিনি বলেন, আইএসআই শুধু ভারতীয় জালনোট নয়, রোহিঙ্গাদের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য আরও ভয়াবহ হুমকি ডেকে নিয়ে আসবে।

গোয়েন্দ সূত্রের খবর, করোর মহামারী কিছুটা স্থিমিত হওয়ার পর বিমান পরিষেবা চালু হওয়ায় সর্বশেষ এ বছর ২০ মার্চ (২০২১) ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫০ লক্ষ দুই হাজার ভারতীয় জালনোট-সহ ফকরুল ইসলাম নামের এক যাত্রীকে আটক করেছে বিমানবন্দর কাস্টমস। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি ৪০৪৮ ফ্লাইটে দুবাই থেকে ঢাকায় আসেন চাঁদপুরের ফকরুল ইসলাম। তবে জালনোট-সহ ধরা পরলেও তাকে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে আটক দেখানো হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ভারতীয় জাল টাকা তৈরি করা অবস্থায় ২০২০ সালের গ্রেফতার ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান পরিচালনা চালিয়ে জাকির হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, বাদল খান, মালেক ফরাজী, জসিম উদ্দিন ও শিহাব। গ্রেফতারকালে তাদের কাছে থেকে ২০ লক্ষ জাল ভারতীয় রুপি উদ্ধার করা হয়েছে। ‘২০১৯ সালেও এই চক্রের জাকির ও তার স্ত্রী ডেমরা থানা এলাকায় একটি অত্যাধুনিক বাসা থেকে জাল রুপি উৎপাদনকালে গ্রেফতার হয়েছিল।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ১৫ জুলাই, ২০১৯ বাংলাদেশের রাজধানীর রামপুরা এলাকার পলাশবাগ মোড়ের একটি আবাসিক ভবনে অভিযান পরিচালনা করে এ ভারতীয় জাল রুপি তৈরির কারখানার সন্ধান পায় এবং রফিকুল ইসলাম খসরু, মো: আব্দুর রহিম ও জনি ডি কস্তা নামে তিন জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছে থেকে ভারতীয় ৫০০ ও ২০০০ টাকা মূল্যমানের সর্বমোট সাড়ে উনিশ লক্ষ জাল রুপির নোট এবং জাল রুপি তৈরির কাজে ব্যবহৃত জাল রুপি তৈরির বিপুল পরিমাণ কাগজ, প্রিন্টারে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কালি, সিকিউরিটি সিল সম্বলিত স্ক্রীন বোর্ড, গাম ও ভারতীয় জাল রুপি বানানোর জন্য ব্যবহৃত সিল মারা ফয়েল পেপার উদ্ধার করা হয়।
বাংলাদেশের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান বলেন, জাল রুপির কারবারীদের নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কেননা বাংলাদেশ নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই তাদের গ্রেফতারে সব-ধরণের প্রক্রিয়া অব্যহত রেখেছে। এছাড়া বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে যাতে কেউ পাশ্ববর্তী দেশের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সর্বদা সজাগ প্রশাসন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কারবারীদের তৈরি করা জাল রুপি নিম্নমানের এবং জল লাগিয়ে ঘসা দিলেই রং উঠে যায়। আর আধুনিক কোন মেশিন ছাড়াই একটু উন্নত মানের কালার প্রিন্টারে ছাপানো হয়। তাই বাংলাদেশে ছাপানো জাল টাকা এবং ভারতীয় রুপি একটু ভালোভাবে পরীক্ষা করলেই আসল নকল নির্ণয় করা সম্ভব। তবে একই চক্র বারবার গ্রেফতার হয়ে জামিনে বের হয়ে ফের ভারতীয় জাল রুপি এবং বাংলাদেশের জাল টাকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এটা চিন্তার বিষয়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১ অক্টোবর খুলনা জেলার কয়রা থানা এলাকায় ভারতীয় জাল নোট সহ ৩ আসামীকে গ্রেফতার করেছে খুলনা জেলা ডিবি পুলিশ। এসময় তাদের নিকট থেকে ২ লক্ষ ৯৬ হাজার রুপি মূল্য মানের ভারতীয় জাল নোট উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় বাংলাদেশের কয়রা থানার সাফিয়া বেগম ও সাইফুল ইসলাম, সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানার মোছাঃ রেবেকা খাতুন, মোঃ রমজান আলী এবং একই এলাকার মোছাঃ জাহানারা বেগম ও মোঃ কাজল ইসলা কে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এবছর (২০২১) ২১ জুন ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনামসজিদ স্থলবন্দরের ৫ নং গেটের সামনে অভিযান চালিয়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার ভারতীয় জাল রুপিসহ একজনকে হাতেনাতে আটক করেন গোয়েন্দা শাখার পুলিশ। আটককৃত ব্যাক্তি শিবগঞ্জ উপজেলার শিয়ালমারা গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে মোঃ আব্দুল বারী ওরফে তুহিন। ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশের সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা থেকে ৪৪ হাজার জাল রুপিসহ ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার সরুপনগর থানার দরকান্দা গ্রামের ইব্রাহিম গাজী ছোট’কে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ।

সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় জাল রুপির রমরমা বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ করেছেন বেনাপোল স্থলবন্দরের শারর্শা উজেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে জাল রুপিসহ গ্রেফতার হলেও সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাদের সুপারিশে প্রশাসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বলেন, পাসপোর্টধারী অনেক যাত্রী না বুঝে প্রতারকদের কাছ থেকে বাংলাদেশী টাকার বিপরিতে ভারতীয় জাল রুপি নিয়ে বিপদে পরছেন। জাল রুপির কারণে নাজেহাল হচ্ছে ভারতে গিয়ে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি ঢাকার তেজগাঁওয়ে তিন লাখ ভারতীয় জাল রুপিসহ পাকিস্তানি নাগরিক মাহমুদ রেহমান , মোজাম্মেল হক, ফারুক আহাম্মেদ গ্রেফতার করে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স ‘র‌্যাব’। ২০১৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি নাগরিক আবদুল্লাহ ওরফে সেলিম, জাহাঙ্গীর ও খালেক এ দেশে চক্রটির প্রধান সমন্বয়ক। তাদের কাছ থেকে এক কোটি ভারতীয় জাল রুপি, ছয় লাখ রুপি জব্দ করে ‘র‌্যাব’। তারা জাল মুদ্রা বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ ফের পাকিস্তানে চক্রের হোতাদের কাছে পৌঁছে দেন বলে র‌্যাবের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়।

তবে বাংলাদেশ সুপ্রিক কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিষদ সদস্য মিন্টু কুমার মন্ডল বলেন, ভারতীয় রুপি অথবা বাংলাদেশী জাল টাকার কারবারীদের ব্যাপারে কোনও মনিটরিং নেই। কারা জামিন করাচ্ছেন, কিভাবে হচ্ছে এ-বিষয় নজর দেওয়া দরকার। সেটা নেই বলেই গ্রেফতার হয়ে কিছু দিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। যেহেতু এর পিছনে বিদেশী শক্তি রয়েছে তাই জামিনে বের হয়েই ফের জড়িয়ে পড়ছে জালনোটের কারবারে সঙ্গে। দু’দেশকে মিলেই এর লাগাম টানতে হবে।