নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৪ জুলাই৷৷ ত্রিপুরায় আজ ঐতিহ্যবাহী কের পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ আগরতলার উজ্জয়ন্ত প্রাসাদে প্রথা মেনে জনজাতিদের এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এ উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে করোনা-প্রকোপের পরিস্থিতিতে সকলের মঙ্গল কামনা করেছেন৷
ত্রিপুরার রাজবংশের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব কের পূজাঊ শ্রাবণ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে সাত দিনের খারচি পূজা ১৪ দেবতার মন্দিরে শেষ হওয়ার পরের সাত দিনের মাথায় শুরু হয় কের পূজাঊ হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীর পূজায় যে সব আচার-উপাচার দেখা যায়, তা কের পূজায় দেখা যায় নাঊ প্রথমত, উপাস্য দেব-দেবীর কোনওরকম মূর্তি নেই এই পূজায়ঊ এর আচার-অনুষ্ঠান অনুপমঊ আদিভৌতিক শক্তির ভয় থেকে রক্ষা পেতে এই পূজা করা হয় এবং আচার-অনুষ্ঠানের পুরোহিত এবং যার নির্দেশে এই পূজা সম্পাদিত হয় তাঁর নাম চন্তাইঊ কের পূজায় কঠোর নিয়মকানুন মানা হয়ঊ ওই নিয়ম চন্তাই যেমন নিখুঁতভাবে মানেন, তেমনি এই নিয়ম পালনে জন-ঘোষণাও করা হয়ঊ এটাও তাঁদের পরম্পরাগত রীতিঊ বলা হয়ে থাকে, যে এই নিয়ম ভঙ্গ করবেন তাঁকে দৈবশক্তির কাছে শাস্তি পেতে হবেঊ
কের ও খারচি, উভয় পূজাই রাজ-পরিবরের ও ত্রিপুরী উপজাতিদের পূজাঊ কিন্তু, ত্রিপুরা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে এবং গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম হতেই উভয় পূজার পৃষ্ঠপোষক রাজ্য সরকার স্বয়ংঊ দুটো পূজার ক্ষেত্রেই সরকারি পুলিশ পূজার পবিত্রতা রক্ষায় নিয়োজিত থাকেঊ
তবে কের পূজাকে ঘিরে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞামূলক সংস্কারও রয়েছেঊ এই পূজার দিনগুলিতে সমাজের প্রধান হয়ে ওঠেন চন্তাইঊ কের পূজার সংস্কার কোনও কারণে কেউ ভঙ্গ করলে চন্তাই মহারাজ তাঁকে শাস্তি দিতে পারেনঊ আজকাল কের পূজার সংস্কার ও বিধিনিষেধ বলবৎ থাকে পুজাস্থল সহ তার বাইরে বিরাট এলাকা জুড়েঊ অবশ্য কের পূজার নিয়ম-কানুনের এই গণ্ডি উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের পশ্চিম দিকের একটি অংশের মধ্যেই এখন সীমাবদ্ধঊ নির্ধারিত ওই এলাকায় লোকজনকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না৷ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এই সময়৷ রাজবাড়ির বাইরে শহরের নির্দিষ্ট একটি বলয়ের মধ্যেও এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে রাত ১০টা থেকে সকাল ৫-টা পর্যন্ত ঊ সেই সব স্থানে বসবাসকারী লোকজনদের ওই সময়কালে বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ থাকেঊ এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে কের পূজার প্রথম ৩২ ঘণ্টার সময়কালের জন্যঊ
আরও নিষেধাজ্ঞা আছে, যেমন কোনও অসুস্থ ব্যক্তিকে কের পূজাস্থল এলাকায় থাকতে দেওয়া হয় নাঊ তেমনি ওই অঞ্চলে সে সময় কোনো অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলা থাকলে, কের পূজার পবিত্রতা রক্ষার জন্য তাঁকে ওই সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়ঊ শিশুর জন্ম ও মৃত্যুর সম্ভাবনা, যা পূজার পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে, তা রোধ করতেই এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় বলে জানা যায়ঊ রাজ পরিবারের সদস্য ও মহারাজার আত্মীয়-স্বজন জুতো পরেন না৷ এই সময় তাঁদেরকে খালি পায়ে থাকতে হয়ঊ এমন-কি, ছাতা ব্যবহার করাও নিষিদ্ধঊ আদিভৌতিক শক্তিকে তুষ্ট করতে এই সময়কালে কোনও রকম বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, নৃত্য, সঙ্গীত, গান-বাজনা করা নিষিদ্ধ থাকে৷ শুধুমাত্র চন্তাইয়ের সহকারীরা সমবেত স্তোত্র পাঠ করতে পারেন ঊ
চন্তাই বিশ্বাস করেন, কের পূজার এই বিধিনিষেধ অমান্য করলে অশুভ শক্তিকে আহ্বান করা হয় এবং পূজার পবিত্রতা তাতে অশুচি হয়ঊ কের পূজার দিনক্ষণ স্থির হওয়ার পর আগের দিন চন্তাই জিপ গাড়ি চড়ে পূজা স্থলে আসেন৷ তথন তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মর্যাদা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে সেখানে থাকেন রাজকর্মচারীরা ও ত্রিপুরা সরকারের দেবস্থান পরিচালন কমিটির পদাধিকারীরা, যাঁরা চন্তাই ও তাঁর সহকারীদের খাওয়া-থাকার সুবন্দোবস্ত করেনঊ পূজা শুরু হয় কামানের গোলা ফাটিয়ে৷ নাগরিকদের পূজা শুরুর বার্তা জানাতেই এটা করা হয়ঊ এর পর পূজার যাবতীয় উপাচার শুরু হয়ে যায়ঊ পূজা শেষ হলেও তেমনি গোলা ফাটানো হয়ঊ
পরের দিন ভোরের দিকে চন্তাই রাজকীয় পোশাক পরে আসেন পুজাস্থলেঊ তাঁর মাথায় থাকে পাগড়ি, গায়ে রঙিন ঝুলঝুলে জামা, সাদা ঢিলা কোমরবন্ধ এবং স্বর্ণালী সুতোর তাগাঊ এই পরিচ্ছদের প্রতিকী অর্থ হল উপাস্য দেবতা এগুলোর মধ্যেই নিহিতঊ চন্তাই এর পর তাঁর সহকারীদের নিয়ে এবং পেছনে সরকারি ও রাজকর্মচারীদের নিয়ে শোভাযাত্রা করে মাণিক্য শাসনের হাতির দাঁত ও রুপো দিয়ে তৈরি প্রাচীন সিংহাসনের কাছে গিয়ে সম্মান জানানঊ
এর পর তাঁরা রাজবাড়ির ভেতরে রাখা মঙ্গলচণ্ডী দেবীর কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানানঊ পরে তাঁদের উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের সদর দেওরি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে নির্ধারিত পবিত্র স্থানের দিকে রওয়ানা করা হয়ঊ ওই পবিত্র স্থান হচ্ছে আয়তাকার এক খণ্ড ভূমি, যা কের পূজার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত করে রাখা হয় আগে থেকেইঊ ওই আয়তাকার ভূমি খণ্ডের প্রত্যেক কোণায় সবুজ বাঁশ গাছের খণ্ড পোঁতা হয়ঊ এই বাঁশ গাছগুলি উপাস্য দেব-দেবী ও পূর্ব-পুরুষদের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়ঊ
বাঁশের দণ্ডগুলির এক একটার এক এক রকম আকৃতি এবং প্রত্যেকটি ফুল দিয়ে মোড়া থাকেঊ এদের উপর একটি জ্যামিতিক আকৃতিতে একটি চাঁদোয়া আটকানো হয়ঊ বাইরের দিক থেকে মন্দিরের সদৃশ এই সজ্জাঊ চন্তাই ও সহকারীরা উচ্চৈঃস্বরে অজানা ভাষায় স্তোত্র উচারণ করতে থাকেন৷ যা জনসাধারণকে অশুভ প্রভাব থেকে পরিত্রাণ করে বলে বিশ্বাসঊ চন্তাই পুজাস্থলে, বাঁশে-বাঁশ ঘসে আগুন জ্বালান, পূজার পর ওই আগুনের ভস্ম উপজাতি, অ-উপজাতি লোকজনেরা ঘরে নিয়ে যানঊ তাঁরা বিশ্বাস করেন, ওই ভস্ম পরিবারে কল্যাণ করে, অপদেবতার কু-দৃষ্টি থেকে রক্ষা করেঊ পশু, পাখির বলি দেওয়াও এই পূজার অন্যতম উপাচারঊ
ত্রিপুরার রাজবাড়ি উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ ও পুরাণ হাবেলিতে কের পূজা যেমন করা হয়, তেমনি উপজাতি সাধারণ মানুষ ফসল রোপণের পর গ্রামে গ্রামে সামাজিকভাবে এই পূজা করেনঊ
কের পূজা উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা ত্রিপুরাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং সকলের মঙ্গল কামনা করেছেন৷ ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবও কের পূজা উপলক্ষ্যে রাজ্যবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি সকলের মঙ্গল কামনা করেছেন৷ তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন৷