কিশোর সরকার
ঢাকা, ২৬ অক্টোবর (হি.স.): মিথ্যে তথ্য প্রচার করে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে পাকিস্তানপন্থীরা। এর ফলে বাংলাদেশের মুসলিমদের ভারতের প্রতি ক্ষোভ ও বিদ্বেষ ক্রমেই বাড়ছে। সর্বোপরি ভুগতে হচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের। এমনই অভিমত বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও হিন্দু সংগঠনের নেতাদের। তাঁদের মতে, ভারতের প্রতি বিদ্বেষ আরও বাড়তে থাকলে এবং নির্যাতনকারীদের শাস্তি না হলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন আরও চরমে পৌঁছবে। বাংলাদেশের সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও হিন্দু সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে বহুভাষী সংবাদ সংস্থা ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-এর সঙ্গে বার্তালাপ করেছেন বাংলাদেশের বাংলাদেশের রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন ও প্রাক্তন বাণিজ্য মন্ত্রী জি এম কাদের।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হিংসার পর ভারতীয় চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করা হলেও, ইউটিউব-সহ সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার রুখতে প্রসাশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি তথা লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেছেন, সম্প্রতি দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা যেভাবে কুমিল্লা থেকে রংপুর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা করেছে, এগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা নয়। পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের ওয়াজে, জুমার নামাজের খুতবায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ইসলামী টিভি ও ব্লগে ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত ও ভিন্ন জীবনধারার অনুসারী মানুষদের পাশাপাশি ভারত ও হাসিনা সরকারের প্রতি বিষোদগার একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারের প্রশাসনে পাকিস্তানী প্রেতাত্মা সব সময় ছিল, এখনও আছে। গত এক দশকে আওয়ামী লীগেও এসব প্রেতাত্মার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস অব্যাহত থাকা এটাও তার একটা কারণ। তিনি আরও বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকার সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন করতে পারেনি, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের শাস্তি দিতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে, প্রধানত প্রচলিত আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্য সরকার দায়ী এ কথা বলা পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের পক্ষাবলম্বন করারই নামান্তর। তবে সরকারের মধ্যে জামাত ঢুকে পরায় প্রশাসন অনেকক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে এটা বলা যায়। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার বন্ধ সম্ভব হচ্ছে না।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে চোরাচালানকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের হতাহতের ঘটনা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচার না হওয়ার নেপথ্যে কী কারণ থাকতে পারে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শার্শা উপজেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম এ রহিম বলেছেন, সম্প্রতি বেনাপোলের পটুখালি বিওপি ক্যাম্পে খুলনা ২১ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সেই সময়ের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরান উল্লা সরকারের সঙ্গে সীমান্তের সাংবাদিকদের একটি মতবিনিময় সভা হয়েছিল। এই সময় ইমরান উল্লা সরকার গরু পাচারকারীদের ছোড়া বোমা হামলায় একজন বিএসএফ ও একজন চোরাচালানী গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা বলেন। এমনকি প্রায়ই সীমান্তে চোরাচালানকারীদের হাতে ভারতে বিএসএফ আক্রান্ত হয়ে আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কেন প্রকাশ হয় না তা উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, উপস্থিত সমস্ত সাংবাদিকই বলেছিলেন দেশপ্রেমের জন্যই সত্য সংবাদটি কোনও সংবাদিকরা লেখান না। এমএ রহিম বলেন, সেই সময় কর্নেল ইমরান উল্লা সরকার বলেছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যেহেতু প্রো-ইন্ডিয়ান তাই সীমান্তে কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটলে সেই খবরের সত্যিটা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রচার না হলে দেশের মানুষ সরকারকে ভুল বোঝেন। সীমান্তে হতাহতের ঘটনায় দায় আওয়ামী লীগ সরকারকে নিতে হয়। আর সীমান্তের এসব ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানপন্থীরা রাজনীতি করেন। রহিম বলেন, এরপরে সীমান্তের সাংবাদিকদের বৈঠকও হয়নি আর সত্যি খবরও প্রকাশের ব্যাপারে কারও অনুপ্রেরণা নেই। দেশপ্রেম নিয়েই আছি।
বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতার মতে, ফারাক্কা তিস্তা বাঁধের কারণে বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ নদী সংস্কার, জল শাসন ও ব্যবহার উন্নয়ন পরিষদ এবং বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সাধারণ সম্পাদক তারেকুজ্জামান রেজা বলেছেন, ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধে বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত সেটা দেশের মানুষকে জানানো দরকার। না হলে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ মধ্যে জল সমস্যা নিয়ে পাক-প্রেমীরা যেভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে তাতে কখন জানি বলে ফেলেন রাজধানী ঢাকার ৪৬টি খাল বিলুপ্তের জন্য ভারত দায়ী। তিনি বলেন, দেশের মানুষকে সত্যিটা জানাতেই প্রতি জেলায় কতগুলি খাল-নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। জলাসয় ভড়াট করা হয়েছে তা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা দরকার। না-হলে ভারত বিদ্বেষ বাড়তেই থাকবে।
পদ্মা সেতু-সহ চিনের ঋণ সহায়তায় বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত করতে ভারতীয় গুপ্তচরদের তৎপরতা এবং তাঁদের গ্রেফতারের প্রচার কী সঠিক? এ বিষয়ে বাংলাদেশের রেলপথ মন্ত্রী: বাংলাদেশের রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, পদ্মা সেতু-সহ চিনের ঋণ সহায়তায় নির্মাণাধীন অধিকাংশ প্রকল্পে বাংলাদেশের পরে ভারতের নাগরিকরা বেশি লাভবান হবেন। তাই এই ধরনের অপপ্রচারে কান না দেওয়ার আহ্বান থাকবে দুই দেশের নাগরিকদের প্রতি। আর পাকপন্থীদের এ-ধরণের অপপ্রচার স্বাধীনতার পর থেকে আমরা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
ভারতের স্বদিচ্ছার অভাবে কী বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য বৈষম্য বাড়ছে, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রাক্তন বাণিজ্য মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি.এম কাদের (এমপি) বলেন, এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ। ব্যবসায়ীরা যেখান থেকে স্বল্প মূল্যে এবং কম খরচে পণ্য আনতে পারবেন সেখান থেকেই আমদানি করবেন। ভারত প্রতিবেশী দেশ, পরিবহন ব্যয় কম। তাই ভারত থেকে নিত্যপণ্যের অধিকাংশ আমদানি হয়। ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা মায়ানমার থেকে এনেছেন। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৭৫ টাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে নিয়মকানুন শিথিল করায় আবার বাজারে পেঁয়াজের দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা হয়ে গিয়েছে। তবে কোনও দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈষম্য কতটা এবং কোন কোন পণ্য আসে প্রতিমাসে দেশের গণমাধ্যমের মাধ্যমে নাগরিকদের তা জানানো দরকার। তাহলে পাকপ্রেমীরা দেশের মানুষকে ভারত-বালাদেশ বাণিজ্য বৈষম্য নিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।
কাশ্মীর-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিমদের উপর নির্যাতন করা হয় বলে প্রচার করা হয়, এ বিষয়ে ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রাক্তন পরিচালক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিজবাহ উর রহমানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, কাশ্মীর-সহ ভারতে বিপুল সংখ্যক মুসলিমের বসবাস, তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে তথ্য প্রচার করা হবে তা নিয়ে বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে সত্যিটা জানানো উচিত বাংলাদেশের ইসলামীক দল ও সংগঠন এবং সাংবাদিকদের। জামাতে ইসলাম যেহেতু এ সব নিয়ে রাজনীতি করে তাই ভারতে মুসলিমদের সার্বিক অবস্থা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আসা দরকার।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ব্যাপারে সত্যিটা প্রকাশ্যে আনার কী কোনও প্রয়োজন রয়েছে? বাংলাদেশের হিন্দু সংগঠনের নেতা পলাশ কান্তি দে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, গুজরাটে দাঙ্গার বিষয়ে ইউটিউব-সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্য তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। এত বছর পরেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সত্যিটা তুলে ধরার জন্য কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাই মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। এছাড়া বর্তমানে জামাতে ইসলাম ও হেফাজতে ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে হিন্দু বিদ্বেষী করা হয়েছে। তাই সেটা পড়ে যা শিখবে তাতে তো হিন্দু বিদ্বেষ বাড়বেই। এছাড়া প্রশানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে জামাতের লোকদের বসানো হয়েছে। তারা চাইছে এখানে হিন্দুদের নির্যাতন করা হোক, আর তাই হচ্ছে। এমনকি কুমিল্লা-সহ দেশব্যাপী হিন্দুদের নির্যাতনের ঘটনার জন্য প্রশাসন দায়ী।
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে ভারত-বিদ্বেষ বাড়াতে আইএসআই কী পাকপন্থী সাংবাদিকদের দিয়ে ভারত-বিরোধী মিথ্যে প্রচার করছে? দি এশিয়ান এইজ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার রফিকুল ইসলাম পিন্টু এই প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে ভারত-বিদ্বেষ বাড়াতে পাকিস্তান হাইকমিশন সক্রিয় ভাবে কাজ করছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার পক্ষের সাংবাদিকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রতিটি সংগঠন এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রো-পাকিস্তানিদের বসানো হয়েছে। রিপোর্টারদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ‘বিট’ সহ গুরুত্বপূর্ণ ‘বিটে’ জামাত তাদের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিল অথবা পারিবারিক ভাবে রাজাকার পরিবারের সন্তান এমন লোকদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিটে পাকিস্তানপন্থীদের অনুপ্রবেশ শুধু ভারতের জন্য হুমকি নয়, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্যও তারা ভয়ের কারণ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে বাংলাদশে ৩,৬৮৯ বার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে। এই সংখ্যার নিরিখেই বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন একবার কিংবা তার বেশি কোথাও না কোথাও বিভিন্ন অজুহাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা নির্যাতন হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালেরে মধ্যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের সংখ্য এক শতাংশের নীচে নেমে আসবে বলে বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের গবেষণায় জানা গিয়েছে।

