মেডিক্যাল কলেজ কেলেঙ্কারি: নেতানেত্রী ও আমলাদের ছত্রছায়ায় নির্ভয়ে বেড়ে উঠেছিলেন রাওতপুরা সরকার, সিবিআই নজরে লেনদেন

ভোপাল, ৫ জুলাই : দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে মেডিক্যাল কলেজ স্বীকৃতি কেলেঙ্কারি। ওই কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে রয়েছেন স্বঘোষিত ধর্মগুরু রবি শঙ্কর মহারাজ ওরফে ‘রাওতপুরা সরকার’। সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)-এর এজাহারে (এফআইআর) নাম ওঠার পর বহু বছর ধরে রাজনীতিক ও আমলাদের প্রভাবশালী অনুসারীদের ছত্রছায়ায় তার উত্থানের পর্দা ফাঁস হয়েছে।

সিবিআই-এর এজাহারে বলা হয়েছে, রাওতপুরা সরকারের নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানসহ অন্তত ৪০টি মানহীন মেডিক্যাল কলেজকে ঘুষ, ভুয়া নথি ও কারসাজি করে পরিদর্শনের মাধ্যমে স্বীকৃতি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এজাহারে ৩৪ জনের নাম রয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন (এনএমসি), বিভিন্ন বেসরকারি কলেজের প্রতিনিধি ও মধ্যস্থতাকারীরা।

সম্প্রতি, ছত্তিশগড়ের নব রায়পুরের শ্রী রাওতপুরা সরকার মেডিক্যাল কলেজের পক্ষে অনুকূল রিপোর্ট তৈরি করতে তিন চিকিৎসকসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৫৫ লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই টাকা হাওয়ালার মাধ্যমে বিতরণ হয়েছিল বলে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে।

১৯৬৮ সালের ৫ জুলাই মধ্যপ্রদেশের টিকমগড় জেলার চিপরি গ্রামে জন্ম রবি শঙ্করের। আশৈশব আধ্যাত্মিক ঝোঁক থাকলেও, নব্বইয়ের দশকে ভিন্ধ জেলার রাওতপুরা গ্রামে নিজের কেন্দ্র গড়ে তোলার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। পরে ‘শ্রী রাওতপুরা সরকার লোক কল্যাণ ট্রাস্ট’ গড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণে বিস্তার করেন। ২০১৮ সালে ছত্তিশগড়ে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রী রাওতপুরা সরকার বিশ্ববিদ্যালয়।

রাজনীতিক, আমলা, শিক্ষাবিদ, সব মহলে তার প্রভাব বিস্তার ছিল স্পষ্ট। বিভিন্ন সময়ে সরকারি সংস্থার পক্ষপাত, জমি দখল, কলেজ ছাত্রদের অধিকারের লঙ্ঘন, নারী আশ্রমবাসীদের হয়রানির অভিযোগ উঠলেও, তার ট্রাস্টের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ হয়নি।

২০২৩ সালে এক নারী অভিযোগ করেন, আশ্রমে ‘সেবা’র নাম করে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানো ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পুলিশ মামলা না নিলেও, মানবাধিকার কমিশন তদন্ত শুরু করেছিল।

সিবিআই-র তদন্তে উঠে এসেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রক ও এনএমসি-র কিছু কর্মকর্তা ও মধ্যস্থতাকারীরা গোপন ফাইল ফাঁস করে, ভুয়া শিক্ষক, নকল উপস্থিতি ও জাল ডিগ্রির মাধ্যমে কলেজগুলোকে স্বীকৃতি পাইয়ে দিয়েছেন। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি বিভিন্ন রাজ্যে ৪০টিরও বেশি কলেজ এই চক্রের আওতায় এসেছে।

ওই কেলেংকারিতে মূল অভিযুক্তরা হলেন, রবি শঙ্কর মহারাজ ওরফে রাওতপুরা সরকার, ডি.পি. সিং(প্রাক্তন ইউজিসি চেয়ারম্যান), ময়ূর রাওয়াল(গীতাঞ্জলি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং সুরেশ সিং ভাদোরিয়া(ইনডেক্স মেডিক্যাল কলেজ, ইন্দোর)। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধর্মগুরুর উত্থান ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। তদন্তে আরও চমকপ্রদ তথ্য সামনে আসার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

রাওয়াতপুরা সরকার কীভাবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, তার পেছনে ছিল দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও প্রভাব বিস্তারের এক সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। রাওয়াতপুরা সরকার প্রথম থেকেই ধর্মীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার আশ্রম ও ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের আমন্ত্রণ জানাতেন, যেখানে রাজনীতিক ও আমলারা নিয়মিত উপস্থিত হতেন। এতে তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।

তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণের নামে ট্রাস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন, বার্ষিক অনুষ্ঠান ও সাফল্য উদযাপনে রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হতো। এতে রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ও পেশাগত সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।

তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ছিলেন উচ্চপদস্থ আমলা, রাজনীতিক, এমনকি স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রের নীতিনির্ধারকরা। তাদের সন্তানের ভর্তি, চাকরি বা অন্য সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে তিনি তাদের কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য অর্জন করেন।

প্রভাবশালী অনুসারীদের মাধ্যমে তিনি সরকারি অনুমোদন, জমি বরাদ্দ, অনুদান ও অন্যান্য প্রশাসনিক সুবিধা সহজেই পেতেন। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি সংস্থার পক্ষপাত, নীতিমালা লঙ্ঘন ও দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, যা তাকে দীর্ঘদিন ধরে নির্বিঘ্নে কার্যক্রম চালাতে সাহায্য করেছে।

বড় বড় ধর্মীয় সমাবেশ, সামাজিক কার্যক্রম ও মিডিয়ার মাধ্যমে তিনি নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন, যা রাজনীতিকদের কাছে তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। রাজনীতিকরা তার জনপ্রিয়তাকে ভোটব্যাংক হিসেবে দেখতেন, ফলে পারস্পরিক স্বার্থে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। এইভাবে, ধর্ম, শিক্ষা, জনকল্যাণ ও ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার সমন্বয়ে রাওয়াটপুরা সরকার রাজনীতিক ও প্রশাসনিক নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

দেশজুড়ে মেডিক্যাল কলেজকে অনুমোদন দিতে বিপুল ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূতভাবে ইন্সপেকশন প্রক্রিয়া পাশ করানোর ভয়াবহ চক্র সামনে এনেছে সিবিআই। শনিবার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এই দুর্নীতিতে মোট ছয়টি বড় ঘুষ লেনদেনকে কেন্দ্র করে তদন্তে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। সিবিআই-এর তথ্য অনুযায়ী, এই দুর্নীতিতে বিভিন্ন প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আধিকারিক ও মিডলম্যানরা একযোগে কাজ করছিলেন। এই চক্রে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন চিকিৎসক রয়েছেন।

সিবিআই জানিয়েছে, মূল ছয়টি ঘুষের লেনদেনের মধ্যে রয়েছে ছত্তিশগড় স্থিত শ্রী রাওতপুরা সরকার মেডিক্যাল কলেজ অনুকূল রিপোর্ট পাওয়ার জন্য ৫৫ লক্ষ টাকা ঘুষ ইন্সপেকশন টিমকে দেওয়া হয়েছে। এই লেনদেনের নেপথ্যে রয়েছেন মেডিক্যাল কলেজের ডিরেক্টর অতুল তিওয়ারি এবং এনএমসি ইন্সপেক্টরদের কাছে ঘুষ পৌঁছে দেওয়া হয় হাওয়ালা রুটে। বিশাখাপত্তনম স্থিত গায়ত্রী মেডিক্যাল কলেজ এনএমসি সদস্য ড. হরিপ্রসাদকে ৫০ লক্ষ টাকা হাওয়ালার মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছে। এই ঘুষ একটি ঝুলে থাকা অনুমোদন সমস্যার সমাধানের বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে। ওয়ারাঙ্গল স্থিত ফাদার কলম্বো ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস ২০ লক্ষ টাকা ও ৪৬ লক্ষ টাকা দুটি লেনদেন ড. হরিপ্রসাদের মাধ্যমে ইন্সপেকশন রিপোর্টকে প্রভাবিত করার জন্য দিয়েছে।

এদিকে, ইন্ডেক্স মেডিক্যাল কলেজ, ইন্দোর (মালওয়াঞ্চল বিশ্ববিদ্যালয়) তথ্য লিক, ভুয়া শিক্ষক দেখানো, ক্লোন বায়োমেট্রিক এইসব কৌশল ব্যবহার করে অনুমোদন পেয়েছে। তার জন্য শিক্ষা মন্ত্রকের একাধিক অফিসারকে ঘুষ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এছাড়া, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্মকর্তারা নথির ছবি তুলে ব্যক্তিগত ডিভাইসের মাধ্যমে মিডলম্যানদের দিতেন। সুনির্দিষ্ট টাকার অঙ্ক উল্লেখ না থাকলেও উল্লেখযোগ্য অর্থের বিনিময়ে এই কাজ হতো। মধ্যস্থতাকারী আর. রণদীপ নায়ার গোপন তথ্য ব্যবহার করে গুজরাট, মীরাট ও বিহারের কলেজগুলোকে ঘুষের বিনিময়ে আগাম তথ্য সরবরাহ করতেন।

Leave a Reply