ওয়াশিংটন, ২ জুলাই: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন যে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তির পথে এগোচ্ছে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কের উপর প্রচলিত শুল্ক কাঠামোতে বড় রকমের পরিবর্তন আসতে পারে। ট্রাম্প বলেন, “আমার মনে হচ্ছে আমরা ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছি। এটা হবে একেবারেই অন্যরকম এক চুক্তি — যেখানে আমরা প্রতিযোগিতার সুযোগ পাব। এখনই ভারতে প্রবেশের কোনো উপায় নেই, কিন্তু আমি মনে করি, ভারত তার বাজার খুলবে। যদি তারা তা করে, তাহলে এই চুক্তির মাধ্যমে আমরা অনেক কম শুল্কের সুবিধা পাব।”
এই মন্তব্যটি এসেছে এমন এক সময়, যখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে একপ্রকার স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। যদিও দুই দেশের প্রতিনিধিদল কয়েক মাস ধরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, তবুও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতপার্থক্য চুক্তিকে বিলম্বিত করছে। বিশেষ করে, ভারতের দুগ্ধ শিল্প ও কৃষি খাত খোলার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দাবিকে কেন্দ্র করেই মূল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
গত মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘লিবারেশন ডে’ নামে পরিচিত এক ঘোষণার মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের উপর ২৬ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছিলেন ৯০ দিনের জন্য। এই সময়সীমা শেষ হচ্ছে আগামী ৯ জুলাই। যদি এর মধ্যে চুক্তি না হয়, তাহলে এই অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হয়ে যাবে, যার ফলে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল, যেটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুখ্য বাণিজ্য আলোচক রাজেশ আগরওয়াল, বর্তমানে ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন। সূত্র অনুযায়ী, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় শেষ মুহূর্তের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং এই কারণে তারা তাদের সফরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। ভারতের পক্ষ থেকে আশাবাদী থাকা হয়েছে যে, চুক্তিটি সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দাবি হল, ভারত যেন তার দুগ্ধ খাত আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য উন্মুক্ত করে। বর্তমানে ভারত এই খাতকে অত্যন্ত সংরক্ষিত রেখেছে, স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি দুগ্ধ উৎপাদকদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, এই খাত খুলে দিলে তারা ভারতের বিশাল বাজারে প্রবেশ করতে পারবে, যা তাদের দুগ্ধ শিল্পের জন্য লাভজনক হবে।
এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র চায় কৃষিজ পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হোক — এর মধ্যে রয়েছে আপেল, আখরোট, বাদাম জাতীয় ফল, ও জেনেটিকালি মডিফায়েড ফসল। মার্কিন পক্ষ বলছে, এসব ক্ষেত্রে ভারত অত্যধিক শুল্ক আরোপ করে রাখায় মার্কিন পণ্যের প্রতিযোগিতা ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে, ভারত চায় যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় তৈরি পোশাক, রত্ন ও গয়না, চামড়াজাত সামগ্রী, ও কৃষিপণ্য — যেমন চিংড়ি, তেলবীজ, আঙুর ও কলার ক্ষেত্রে বাজারে প্রবেশাধিকারে ছাড় দিক। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ সহজ করতে শুল্ক ছাড় ও কোটার মতো সুবিধা চায়, যাতে ভারতের MSME খাত ও কৃষকরা লাভবান হতে পারেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তির উপর শুধু দুই দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ নয়, বরং কৌশলগত সম্পর্কও অনেকাংশে নির্ভর করছে। চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সহযোগিতার পাশাপাশি বাণিজ্যিক পারস্পরিকতা বাড়ানো এই মুহূর্তে উভয় দেশের স্বার্থেই জরুরি।
তবে, কৃষি ও দুগ্ধ খাতের মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রে দ্রুত সমঝোতা হওয়া কঠিন — বিশেষ করে ভারতের পক্ষ থেকে যেখানে বহু কোটি কৃষকের জীবিকা জড়িত। একইভাবে, ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির ছাপ রয়েছে তাদের কৌশলে।
আগামী ৯ জুলাইয়ের মধ্যে যদি এই চুক্তি সম্পন্ন না হয়, তবে ভারতীয় পণ্যের উপর ২৬ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হবে, যা ভারতের রপ্তানি শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াবে। দুই দেশের কর্মকর্তারা শেষ মুহূর্তে আপসরফা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন — এখন দেখার বিষয়, উভয় পক্ষ কতটা ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকে।
এই চুক্তির সফলতা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কৌশলগত সমঝোতা এবং সময়মতো সমাধানে পৌঁছানোর দক্ষতার উপর। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এই বাণিজ্য চুক্তির গতিপথ অনেকটাই নির্ধারণ করে দিতে পারে।