সিয়াং বাঁধের বিরুদ্ধে আদি জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদে ১১৪ বিজ্ঞানী ও গবেষকের সংহতি, প্রকল্প বন্ধের আহ্বান

ইটানগর, ১০ জুন: অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং উপত্যকায় প্রস্তাবিত ‘সিয়াং আপার মাল্টিপারপাস প্রজেক্ট’ (SUMP) বা উপরের সিয়াং বাঁধের বিরুদ্ধে আদি জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদে সংহতি জানিয়ে ১১৪ জন বিজ্ঞানী, গবেষক ও পেশাজীবী একটি যৌথ বিবৃতি জারি করেছেন। তারা বলেছেন, প্রকল্পটি পূর্ব হিমালয়ের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চলকে চরম হুমকির মুখে ফেলবে। বিশেষ করে বেগিং গ্রাম ও বিস্তৃত সিয়াং উপত্যকার পরিবেশ, কৃষি ব্যবস্থা এবং সামাজিক কাঠামো এই প্রকল্পের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

আদি জনগোষ্ঠীর কাছে সিয়াং নদী, যাকে তারা ‘আনে সিয়াং’ বা ‘মা সিয়াং’ নামে আখ্যায়িত করে, শুধু একটি নদী নয়—বরং তাদের সংস্কৃতি, জীবনধারা ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। প্রস্তাবিত বাঁধ চালু হলে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যবাহী সিঁড়ি-আকৃতির ধানক্ষেত, মাধ্যাকর্ষণ-নির্ভর সেচব্যবস্থা এবং প্রজন্ম ধরে চলে আসা কৃষি জ্ঞান। বিজ্ঞানীরা এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করে বলেন, ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে কখনোই ভূমির সঙ্গে গড়ে ওঠা পরিচয়, প্রাকৃতিক জ্ঞান এবং প্রথাগত অধিকারগুলির যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য হটস্পট হিসেবে স্বীকৃত। গত ১৫ বছরে এখানে ৪৮টিরও বেশি নতুন প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিয়াং সোয়াম্প ইল (Ophichthys hodgarti), গোল্ডেন মাহসির (Tor putitora), ভেলভেট ওয়ার্ম (Typhloperipatus williamsoni), Opsarius siangi, Glyptothorax siangensis প্রভৃতি। এই দুর্লভ প্রজাতিগুলি নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহের উপর নির্ভরশীল এবং বাঁধ নির্মাণ তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিবৃতিতে বিজ্ঞানীরা তিনটি প্রধান দাবি উত্থাপন করেছেন: উপরের সিয়াং বাঁধ প্রকল্পের সকল কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করতে হবে; বন অধিকার আইন অনুযায়ী আদিবাসী সম্প্রদায়ের বন ও সম্পদের অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে; এবং ‘ফ্রি, প্রায়র অ্যান্ড ইনফর্মড কনসেন্ট’ (FPIC) নীতির আওতায় জনগণের পূর্ণ মতামত গ্রহণ করতে হবে।

এই বিবৃতি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন অরুণাচল প্রদেশে আগাম ও তীব্র বর্ষণে ভূমিধস, বন্যা ও পরিকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রমাণ করে যে, ভূমিকম্পপ্রবণ এবং জলবায়ু সংবেদনশীল অঞ্চলে বড় অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণ বিপজ্জনক। ১৯৫০ সালের ৮.৬ মাত্রার বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ঘটনাও এই অঞ্চলকে ‘সিসমিক জোন V’-এ ফেলেছে, যা অতিমাত্রায় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।

বাঁধ প্রকল্পটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ঝুঁকিই নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয়ের ওপরও আঘাত হানবে। চীনের তিব্বত অঞ্চল থেকে উৎপন্ন সিয়াং নদী শুধু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নয়, বরং তিব্বত ও ভুটান মিলিয়ে প্রায় ১৩ কোটি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আদি জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের গভীরে এই নদীর অস্তিত্ব। হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্প, টানেল কাটা এবং রিজার্ভয়ার নির্মাণ এই ঐতিহ্যকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে।

গবেষণায় সম্প্রতি এমন কিছু প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলি শুধুমাত্র সিয়াং উপত্যকায় দেখা যায়—যেমন Cyrtodactylus siangensis (২০২৪), Indo-Burmese pangolin, Paraparatrechina neela (নীল ধাতব পিঁপড়ে), Pseumenes siangensis (মাটির হাঁড়ি বানানো বোলতা), Aborichthys bajpaii, Opsarius siangi, Petaurista siangensis, সহ আরও অনেক নতুন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি। এই প্রজাতিগুলোর টিকে থাকা নির্ভর করে নদী ও এর আশেপাশের বাস্তুতন্ত্রের অক্ষুণ্নতার উপর।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সিয়াং উপত্যকার আদি জনগণের প্রতিবাদ একটি বৈধ, সংবেদনশীল এবং গণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া, যা ভারতের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সম্মানযোগ্য। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা শেষ পর্যন্ত আহ্বান জানিয়েছেন যে, অরুণাচলের উন্নয়নের যেকোনো পরিকল্পনা প্রকৃতি, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং জনগণের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিচালিত হওয়া উচিত। উপরন্তু, উপরের সিয়াং বাঁধ প্রকল্প স্থগিত করে আদি জনগোষ্ঠীর অধিকার ও মতামতকে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *