ত্রিপুরায় যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বাড়ছে এইডস-আক্রান্তের সংখ্যা, আগরতলার সমস্ত কলেজ পড়ুয়ার নমুনা পরীক্ষার নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর

আগরতলা, ১ ডিসেম্বর (হি.স.) : ত্রিপুরায় বেড়ে চলেছে মারণব্যাধি এইচআইভি এইডস আক্রান্তের সংখ্যা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই যুব সম্প্রদায়ের। তাই আগরতলার সমস্ত কলেজে পড়ুয়াদের এইডস-এর নমুনা পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, প্রত্যেক দিন জিবি হাসপাতালে ২ থেকে ৩ জন এইচআইভি আক্রান্তের সন্ধান মিলছে। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই কলেজ পড়ুয়া। তাঁর দাবি, সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণেই এইচআইভি সংক্রমণ কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। আজ বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষ্যে প্রজ্ঞাভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে এ কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এইচআইভি সংক্রমিতদের উন্নততর চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের লক্ষ্যে রাজ্যে একটি জাতীয়মানের প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তাঁর কথায়, ড্রাগসের মতো অশুভ শক্তি থেকে যুব সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এবং এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধে মহিলা সহ সবার সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সম্প্রতি এইচআইভি সংক্রমণের পরিসংখ্যানের দিকে সজাগ দৃষ্টি রয়েছে রাজ্য সরকারের। সংক্রমিতদের দ্রুত শনাক্তকরণের মাধ্যমে যথোপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে এনএসএস সহ স্বেচ্ছাসেবক বিভিন্ন সংগঠনগুলিকে যুক্ত করা যেতে পারে। সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাকে গোপন না রেখে সঠিক সময়ে চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন মুখ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, যুব সম্প্রদায়ের সুনিশ্চিত এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যত নির্মাণের লক্ষ্যে স্টার্টআপ, আইটি হাব সহ নানান উদ্ভাবনী পরিকল্পনার পথে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। তার আগে প্রয়োজন যুব সম্প্রদায়ের সুস্থ জীবনযাপন। এক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে হবে সবাইকে। সমস্যার মূলে গিয়ে তার সমাধান নির্মূলীকরণে দফতরের আধিকারিকদের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পাশাপাশি যেখানেই অস্বাভাবিক সংক্রমণের হার দেখা যাবে সেখানে অধিক সংখ্যায় পরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিতকরণ এবং সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ মূল্যায়নেরও নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধে অন্যতম শর্ত হল ড্রাগস এবং সিরিঞ্জের মাধ্যমে নেশাদ্রব্য ব্যবহার থেকে যুব সম্প্রদায়কে বিরত রাখা।তাঁর মতে, চিকিৎসার পাশাপাশি এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, এইচআইভি সংক্রমিত বা যাঁরা ভুলবশত নেশার ফাঁদে পা দিয়েছেন তাঁদেরকে অস্পৃশ্য ভেবে দূরে সরিয়ে না রেখে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাবনায় জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা হোক। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এইচআইভি সংক্রমিতদের উন্নত চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে আধুনিক পরিষেবা-সম্পন্ন জাতীয়মানের একটি চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে তাঁর সরকার।

মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, নেশার কবল থেকে যুব সম্প্রদায়কে মুক্ত রাখতে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে মহিলাদের। রাজ্যে যেভাবে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা হয়েছে বা করোনা ভাইরাস সংক্রমণ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, একইভাবে এইডসকেও প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ ও সমাজশিক্ষা, শিক্ষা দফতর, পুলিশ প্রশাসন সহ প্রয়োজনে অন্যান্য দফতরকে যুক্ত করে, সমাজের সকল অংশের নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নেশার মতো সামাজিক ব্যাধি ও এইচআইভি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসার আহ্বান রাখেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে সমাজকল্যাণ ও সমাজশিক্ষা মন্ত্রী সান্ত্বনা চাকমা বলেন, এইডসকে প্রতিহত করতে সবার আগে প্রয়োজন এই রোগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা। জোরপূর্বক এই পথ থেকে তাদেরকে সরিয়ে আনার বদলে ভালোভাবে বুঝিয়ে সঠিক চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দিতে পারলেই মিলবে সার্থকতা। তাঁর দাবি, এইচআইভি সংক্রমিতদের মধ্যে যোগ্য সুবিধাভোগীদের সমাজকল্যাণ দফতর থেকে সামাজিক ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। তার পাশাপাশি যারা নতুনভাবে সংক্রমিত হচ্ছে তাদেরও এই তালিকায় সংযুক্তিকরণের প্রক্রিয়া চলছে। এই সমস্যা দূরীকরণে সবার সম্মিলিত সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন মন্ত্রী সান্ত্বনা।

প্রসঙ্গত, ত্রিপুরা স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, ত্রিপুরায় ২,৪৫৯ জন এইচআইভি আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মহিলা ৭৫০ জন এবং পুরুষের সংখ্যা ১,৭০৯ জন। গত ২০ বছরে প্রায় ৬৪০ জন এইচআইভি আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য গোটা রাজ্যকে চিন্তায় ফেলবে বলাই বাহুল্য। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মধ্যে এই মারণ ব্যাধিতে সংক্রামিত এমন ৫৬০ জনের হদিশ মিলেছে। এমন-কি সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে ৮৬০ জন এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শুধু এ বছরই আক্রান্তের সন্ধান মিলেছে সংখ্যায় প্রায় ৩০০। এদিকে, জেলাভিত্তিক এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর হিসাবে দেখা গেছে, উত্তর ত্রিপুরায় ৫৯৪ জন, পশ্চিম ত্রিপুরায় ৫৬৪ জন, ধলাই জেলায় ৪০৮ জন, উনকোটি জেলায় ২৬১ জন, খোয়াই জেলায় ১৮৮ জন, গোমতি জেলায় ১৮৩ জন, সিপাহিজলা জেলায় ১৩৭ জন এবং দক্ষিণ ত্রিপুরায় ১০৯ জন সংক্রামিত রয়েছেন। বহিঃরাজ্যের ১৫ জন নাগরিক বর্তমানে ত্রিপুরায় অবস্থান করছেন।

এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির প্রজেক্ট ডিরেক্টর ডা. দীপকুমার দেববর্মা বলেন, রোগীদের চিকিৎসায় সারা রাজ্যেই পরিকাঠামো সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। ওএসটি সেন্টার এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং মহকুমা হাসপাতালে এই পরিষেবা গত জানুয়ারি থেকে চালু করা হয়েছে। তাঁর দাবি, এখন পর্যন্ত ১,৭৯৭ জন এইচআইভি আক্রান্ত ওই সেন্টারে নাম নথিভুক্ত করেছেন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসার স্তর সম্পূর্ণ করেছেন ৩০০ জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *