নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৩ অক্টোবর৷৷ সবেমাত্র চৌদ্দ বছর পাঁচ দিন৷ শিক্ষাজীবনের প্রকৃষ্ট সময়৷ কিন্তু সব কিছুকেই পেছনে ঠেলে ঘরের মেয়েকে পরের হাতে তুলে দিতে তৎপর পরিবার-পরিজনরা৷ যদিও আইনি বেড়াজালে খবর লেখা অব্দি নাবালিকা মেয়ে অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে৷ রবিবার ঘটা করেই কল্যাণপুর থানা এলাকার পূর্বকল্যাণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন অমর কলোনি শরণার্থী শিবিরে নিজের আস্তানায় বিয়ের আসর তৈরি করেছিল জনৈক ব্যক্তি৷ সকাল থেকেই বাড়িতে সানাইয়ের সুর অন্যদিকে ডিজে সাউন্ড সরগরম৷ পাড়াপড়শি নিমন্ত্রনেও খামতি নেই৷ বাড়ির এক কোণে সুসজ্জিত বিয়ের কুঞ্জ অন্যদিকে ঢালাও ভুরিভুজের উপকরণে প্রস্তুতি পর্ব জোর গতিতে এগোচ্ছে৷
মোটামুটিভাবে বিয়ের প্রাক-প্রস্তুতি সবটাই চূড়ান্ত৷ কিন্তু ঘড়িতে বেলা দুইটা বেজে ত্রিশ মিনিট৷ হঠাৎ এই গোটা বাড়ি পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ৷ কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়িতে ঢুকে পড়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে চাইল্ড লাইনের এক দঙ্গল কর্মকর্তা৷ তলব করা হয় বাড়ির গৃহকর্তা গৃহকর্তীসহ হবুবধুকে৷ প্রাণচঞ্চল লোকে লোকারণ্য বিয়ে বাড়ি যেনো হঠাৎই থমকে পড়ে৷ অনেক চেষ্টায় গৃহকর্তা জানান দেয় বাড়িতে নিজের মেয়ের বিয়ের জন্যই গোটা আয়োজন৷ মহকুমা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট পাত্রীর বয়সের প্রমাণপত্র দেখতে গিয়েই সকলের চক্ষু চড়কগাছ৷ কেননা পাত্রী সবেমাত্র চৌদ্দ বছর পাঁচ দিন আজ৷ বিয়ে ঠিক হয় খোয়াই থানা এলাকার পহরমুরা গ্রামের রাজমিস্ত্রী তাপস পালের সাথে৷
প্রশাসনের তরফে সাথে সাথেই বরের বাড়িতেও পুরো ঘটনা জানিয়ে দেয় এবং আইন বহির্ভূতভাবে বিয়ে মঞ্চস্থ না করার ফরমান জারি করে৷ এদিকে চাইল্ড লাইন ও মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট পাত্রীপক্ষের সাথে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের আইনবহির্ভূত বিয়ে না দেওয়ার অনুরোধ জানায়৷ পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ের আগে মেয়েদের বিয়ে দিলে পারিপাশর্িক পার্শ প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা নিয়েও সম্যক ধারণা দেয়৷ দীর্ঘ সময় শেষে কন্যাপক্ষ আজকের নির্ধারিত বিয়ে বন্ধ করে দিতে সম্মতি জ্ঞাপন করে এবং মুসলেকা দেয়৷ কাগজে-কলমে আমরা সভ্য৷ সভ্যতার অহংকার আমাদের চলনে-বলনে কিংবা কথিত সমাজ দরদী আমরা৷ কিন্তু এর পরেও আমরা সমাজ সংস্কারে কিংবা সমাজের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে কতোটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারছি ? এই প্রশ্ণ কিন্তু বারবার উঁকি দিচ্ছে৷
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের সমাজে নাবালিকা মেয়েদের বিয়ের দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে৷ অনেকক্ষেত্রে হয়তো প্রশাসন কিংবা পুলিশ বিয়ে রুখে দিতে পারছে৷ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজের মধ্যে এখনও নাবালক- নাবালিকাদের বিয়ে প্রবাহমান গতিতে অব্যাহত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷আজ কল্যাণপুর থানাধীন অমর কলোনী গ্রামের জনৈক ব্যক্তি তার নাবালিকা মেয়ে যার বয়স সবে মাত্র ১৪ পেরিয়েছে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল এই খবর যখন প্রশাসনের কানে পৌঁছায় তখন প্রশাসনিক আধিকারিকরা সদল বলে ওই বিয়েবাড়িতে গিয়ে নাবালিকা মেয়ের বিয়ে রুখে দেয়৷
এই সফল অভিযানে ছিলেন ডিসিএম দেবপ্রিয়া দাস, কল্যাণপুর থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক শুভ্রাংশু ভট্টাচার্য, জয়ন্ত দেবনাথ সহ চাইল্ড লাইনের কর্মীরা৷সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট নাবালিকার মা আবার পঞ্চায়েতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও৷ এই ঘটনায় এলাকা জুড়ে একটা চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে৷তৈরি হয়েছে শত শত প্রশ্ণ উঠছে পঞ্চায়েতের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি হয়েও কিভাবে নিজ বাড়িতেই নাবালিকা মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করছেন৷ সে যাই হোক এ যাত্রায় প্রশাসনের সঠিক এবং সময় উপযোগী ভূমিকা গ্রহণের ফলে রুখে দেওয়া সম্ভব হলো আরও একটা নাবালিকা মেয়ের বিয়ে৷ কিন্তু প্রশ্ণ উঠছে আর কতদিন ? আর কবে সম্বিৎ ফিরবে আমাদের এই কথিত শিক্ষিত সমাজের?

