শিলচর (অসম), ২৬ ফেব্রুয়ারি (হি.স.) : এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে শিলচরের ৪০টি পরিবারের ১৯৪ জন সদস্য একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন। ঘটনা শিলচরের পুর এলাকার চেঙকুড়ি রোড সংলগ্ন নিলু পালচৌধুরী লেনে। শনিবার রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ এ সূত্রপাত। এই অগ্নিকাণ্ডে জনৈক মমতা দাস (৫০) যিনি বুড়ুর মা বলে পরিচিত তিনি জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। ঝলসে গিয়েছেন তাঁর পতী শিবচরণ দাসও। তাছাড়া অগ্নিদগ্ধ হলে সংকটজনক অবস্থায় শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে একই পরিবারের চার সদস্যকে। তাঁরা গৃহস্থ রাধাকৃষ্ণ দাস (৩৮) তাঁর পত্নী দীপা দাস (৩০) দুই শিশু সন্তান প্রমিলা (৭) ও নন্দিতা (৩)। তাছাড়া কমবেশি জখম হয়েছেন আরও প্রায় ১৭ জন। এ ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আগুনে ইন্ধন জুগিয়েছে প্রায় আটটি রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ।
বিধ্বংসী ঘটনার পর স্থানীয় বিধায়ক তথা অসম বিধানসভার উপাধ্যক্ষ দিলীপকুমার পাল অকুস্থলে গিয়ে পরিস্থিতির খোঁজ-খবর নেওয়ার পাশাপাশি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ চারজনের শারীরিক অবস্থার খবর নিয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসায় যাতে কোনওধরনের গাফিলতি না হয় সে ব্যাপারেও ডাক্তারদের নির্দেশ তিনি দিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে উপাধ্যক্ষ পালের বক্তব্য, শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট না থাকার পরও যেভাবে ডাক্তাররা অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা করছেন তাতে তিনি সন্তুষ্ট। এবার এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট স্থাপনের দীর্ঘদিনের দাবি সংক্রান্ত বিষয়টি সরকারের কাছে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূরণ করতে আর্জি জানাবেন দিলীপবাবু। জানান তিনি নিজে।
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে উপাধ্যক্ষ দিলীপ পাল জানান, গতকাল রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ নিলু পালচৌধুরী লেনের ঝুপড়ি এলাকায় আগুন ধরে। এতে আগুনের লেলিহান শিখা চোখের নিমেযে এক এক করে প্রায় চল্লিশটি পরিবারের বসতঘরে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে দমকলের চারটি গাড়ি আসলেও সংকীর্ণ গলিপথে আগুন নেভানোর কাজে তাদের ঝাঁপাতে বেশ বেগ পেতে হয়। তবু অক্লান্ত প্রচেষ্টায় প্রায় দু-ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন তারা। ইত্যবসরে লেনের প্রায় সব কয়টি ঘরই জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
দিলীপবাবুর কাছে জানা গেছে, গলির জনৈক দিলীপ পালচৌধুরীর সাতটি, দীপক (নিলু) পালচৌধুরীর তিনটি এবং বাপন মজুমদারের মালিকানায় তৈরি ঝুপড়ি ঘরে এই চল্লিশটি পরিবার বসবাস করত। চল্লিশটি পরিবারের মধ্যে বয়স্ক ১৩৮ এবং কমবয়সি ৫৬ জনকে নিয়ে মোট ১৯৪ জন সদস্যের বাস ছিল এই বস্তিতে। প্রভাবিতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীও রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় পাঁচ-ছয়জন চলমান এবারের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। তাদের একটি বছর এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে বিসর্জিত হয়ে যাওয়ায় খেদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। দিলীপবাবু বস্তির ছাত্রছাত্রীদের আগামীদিনের পড়াশুনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবেন বলে জানিয়েছেন।
গতকাল রাতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে মরণপণ সহায়তা করেছেন এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার মিত্রা রায় ও লাগোয়া ওয়ার্ড কমিশনার অসীম দাস। মূলত তাঁদের প্রচেষ্টায়ই অগ্নিদগ্ধ মমতা দাসের লাশ উদ্ধার হয়েছে। তাঁরা আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে উদ্ধার করেন মমতাদেবীর বৃদ্ধ পতি শিবচরণকেও। উল্লেখ্য, মমতা-শিবচরণের একমাত্র ছেলে বছরখানেক আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। রাধাকৃষ্ণ দাস-সহ একই পরিবারের চার সদস্যকে উদ্ধার করে সঙ্গে সঙ্গে মেডিকযাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থাও ওই দুই ওয়ার্ড কমিশনার করেছেন। লাগোয়া রামানুজ বিদ্যামন্দিরে আশ্রিত পীড়িতদের আজ দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবেন ওয়ার্ড কমশনার অসীম দাস। তাছাড়া চল্লিশটি পরিবারকে তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করেছেন আরেক ওয়ার্ড কমিশনার মিত্রা রায়।
আজ রবিবার সকালে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালের সঙ্গে ফোনে ঘটনার তথ্য জানিয়েছেন উপাধ্যক্ষ পাল। পালের কাছে সব শোনে তৎক্ষণাৎ জেলাশাসককে ঘটনার সরকারি রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ঘটনাস্থলে গিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা তহবিল থেকে নিহত মমতাদেবীর স্বামীর হাতে চার লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন জেলাশাসক এস বিশ্বনাথন। তাছাড়া অন্য ৩৯টি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩,৮০০ টাকা করে দেওয়া হবে বলেও জানান জেলাশাসক।
এদিকে, স্থানীয় বিধায়ক তথা উপাধ্যক্ষের অনুরোধে বিজেপি, শিলচর পুরসভা, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, ফুডগ্রেনস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও পীড়িতদের সাহায্যের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সে অনুসারে পুরসভা দেবে ৪০টি কম্বল, ফুডগ্রেনস দেবে বাসনপত্র, ভারত সেবাশ্রমের পক্ষ থেকে অন্ন ও অন্যান্য খাবার-দাবারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
গতকাল সংঘটিত এই অগ্নিকাণ্ডের পিছনে কোনও ধরনের অন্তর্ঘাত থাকতে পারে বলেও বিস্তর প্রশ্ন ওঠেছে। এই আশংকা একেবারে নস্যাৎ করেননি উপাধ্যক্ষ দিলীপ পালও। উত্থাপিত প্রশ্নের ভিত্তিতে তিনি জেলাশাসককে ঘটনার তদন্তের কথা বলেছেন। জেলাশাসক আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে তাঁর তদন্ত-রিপোর্ট দাখিল করবেন বলে খবর। ভাড়াটেদের উৎখাত করতে এ ধরনের সর্বনাশা ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে কিনা তা-ও তদন্তের আওতায় আনতে বলা হয়েছে। জমির মালিকানাকেই এই অন্তর্ঘাতের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।