BRAKING NEWS

চেনেন না করিমগঞ্জের প্রার্থীদের, তবু নাম কর্তনের ভয়ে নো-ম্যানস ল্যান্ড থেকে কাঁটাতারের গেট পেরিয়ে ভোট দিতে আসবেন ভারত ভূখণ্ডে

লোকসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে আশায় বুক বাঁধছেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নো-ম্যানস ল্যান্ডের সাত গ্রামের ভোটারকুল

।। স্নিগ্ধা দাস ।।

করিমগঞ্জ (অসম)২৫ এপ্রিল (হি.স.) : করিমগঞ্জ সংসদীয় আসনে কে প্রার্থী, চেনেন না, তবুও নাম কর্তন হতে পারে আশংকায় কাঁটাতারের গেট পেরিয়ে ভারত ভূখণ্ডে ভোট দিতে আসবেন তাঁরা। লোকসভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বহু আশায় বুক বেঁধেছেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী সাত গ্রামের ভোটারকুল।

কাঁটাতারের বাইরে ভারতীয় গ্রামে তাঁদের বাড়ি। বড়ির উঠোনের সিংহভাগ রয়েছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। প্রতিটি গ্রামে রয়েছে একাধিক সাদা পিলার, যেগুলোর একদিকে খোদাই করে লেখা আছে ইন্ডিয়া, অন্যদিকে বাংলা। এ ধরনের পিলারই সীমান্ত নির্ধারণ করে দিয়েছে গোটা গ্রামের। অনেকের আবার উঠোনের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সীমান্ত খুঁটি। প্রথম দর্শনে বোঝার উপায় নেই, ভারত বা বাংলাদেশের সীমানা। চরম দুর্দশায় দিন কাটলেও এ ধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত তাঁরা সবাই।

দিনের আলোয় নানাবিধ পরিচয়পত্র দেখিয়ে, নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেলেও সন্ধ্যা গড়ালে আপৎকালীন অবস্থায়ও অনুমতি জোগাড় করলে মেলে নিজের দেশের মূল ভূখণ্ডে পা রাখার অনুমতি। অন্যান্য গ্রামের মতোই সবুজে ভরা তাঁদের গ্রাম। কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়ে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে ভারতীয় মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাঁরা।

নির্বাচনের সময় ভারতীয় গ্রামাঞ্চলে সাময়িকভাবে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। অথচ তাঁদের গ্রামে উড়তে দেখা যায়নি কোনও দলের দলীয় পতাকা। আর রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ভোট যখন একটা সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায়, তখন আর সে দিকটায় নজর না যাওয়াটাই স্বাভাবিক। হোর্ডিং, ব্যানার দূরঅস্ত্, কোনও প্রার্থীর সঙ্গে নেই তাঁদের পরিচয়। ভোটের হাওয়া যেমন নেই তেমনই কোনও দলের প্রার্থীদের নিয়েও গ্রামগুলিতে নেই উত্সােহ। জীবনযন্ত্রণার কথা শুনতে বা ভোটের আবেদন নিয়ে গ্রামমুখী হতে দেখা যায়নি কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মীদের।

লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন ভোটারদের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়াতে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও বিচ্ছিন্ন ওই ভোটারদের নিয়ে কোনও ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়নি জেলা নির্বাচনী আধিকারিকের পক্ষ থেকে।

তবে তাঁরা নিজে থেকে সচেতন, ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটা গেলে আরও দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে আশংকায়। তাই সময় মতোই গণতন্ত্রের বৃহৎ উৎসবে যোগদান করতে কাঁটাতারের গেট পেরিয়ে আসবেন নিজের দেশের মূল ভূখণ্ডে।

সীমান্ত জেলা করিমগঞ্জের উত্তর এবং দক্ষিণের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কাঁটাতারের ওপারে ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্তর্গত নো-ম্যানস ল্যান্ডে রয়েছে সাতটি গ্রাম। যার মধ্যে গোবিন্দপুরে রয়েছে ৪১টি পরিবারের ২৯১ জন, উত্তর লাফাশাইলে ৬৫টি পরিবারের ৪১০ জন, মহিষাশন কুয়োরভাগে রয়েছেন তিন পরিবারে ২১ জন, তেশুয়ায় ২ পরিবারের ১৪ জন, লাতুকান্দিতে ৯ পরিবারের ৬৪ জন, জারাপাতায় এক পরিবার ৮ এবং দেওতলিতে ৮ পরিবারে ৪৯ জন বাসিন্দার বসবাস। সাতটি গ্রাম মিলে ভোটারের সংখ্যা ৪৮১। ওই গ্রামগুলিতে ঢোকার আগেই রয়েছে আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী গেট। যে গেট প্রহরার দায়িত্বে নিযুক্ত থাকেন বিএসএফ-এর জওয়ানরা।

প্রত্যেকের পরিচয়পত্র সহ যাবতীয় নথিপত্র জমা থাকে বিএসএফ-এর কাছে। বাজারহাট থেকে স্কুল, কলেজ, অনুমতি ছাড়া মূল ভূখণ্ডের কোথাও যাতায়াত করতে পারেন না বাসিন্দারা। নো-ম্যান্স ল্যান্ড থাকায় গ্রামে নেই কোনও ভোট কেন্দ্র। তবুও ভোট দিতে ভুল করেন না তাঁরা।

প্রার্থী বা প্রচার, কোনও কিছুর দেখা নেই, তবু বিএসএফ-এর অনুমতি নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন তারা। প্রতিবারের মতো এবারও নিয়ম করে ভোট দিতে কাঁটাতারের লোহার ফটক পেরিয়ে বিএসএফ-এর কাছে গেট পাস জমা দিয়ে ভোটার কার্ড হাতে নিয়ে ছুটে আসবেন ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে গড়ে তোলা ভোটকেন্দ্রে। তার কারণ, ভোটের আবহে আরও একবার আশায় বুক বাঁধছেন তাঁরা। হয়তো-বা এবার বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবেন। দেশ ভাগের যন্ত্রণাকে ভুলে ভারতের নাগরিক হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করবেন তাঁরা সবাই।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার, করিমগঞ্জ সংসদীয় আসনে ক্রমশ পরিবর্তন হচ্ছে জয়-পরাজয়ের হিসাব। ৬৫ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্রে বলতে গেলে এ মুহূর্তে ভালো অবস্থানে রয়েছে বিজেপি। অসমের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্তবিশ্বশর্মার চালে কোণঠাসা বিরোধীরা। করিমগঞ্জ আসনে নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণকারী সংখ্যালঘু ভোট টানতে মরিয়া পদ্ম শিবির। কিন্তু কাঁটাতারের ওপাড়ে বসবাসকারী সব থেকে বড় সংখ্যালঘু গ্রাম উত্তর লাফাশাইলে পৌঁছেনি কোনও উন্নয়নের স্লোগান। খবর নেওয়ার মতো সময় নেই শাসক থেকে বিরোধীদের। গ্রামগুলিতে ভোটার ৭৫ শতাংশ।

নিজের পরিচয় বাঁচিয়ে রাখতে এবার তারা বিএসএফ-এর অনুমতি নিয়ে এপারে এসে কোনও না-কোনও দলের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। গ্রামের মুরব্বি আব্দুল সহিদ, আফতাব আলি, ইসলাম উদ্দিন, শামিম আহমেদরা জানান, বাপদাদার জন্ম এই গ্রামে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ভাগ্য বদল হয়নি তাঁদের। ভোটার কার্ড, আধার কার্ডটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাই আগামীকাল শুক্রবার তাঁরা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। সহমত পোষণ করে আরও অনেকে বলেন, বিএসএফ-এর অবস্থানে গ্রামে শান্তি থাকলে, খোঁজ রাখার মতো নেতা নেই তাঁদের। তাই এমন একজন প্রতিনিধি দরকার যিনি কাঁটাতারের ওপাড়ে আওয়াজ পৌঁছাতে পারবেন দিল্লির দরবারে।

আব্দুল জব্বারের অভিযোগ, গ্রামের শেষ প্রান্তে বাংলাদেশ গজুকাটা সীমান্তে তাঁদের বাড়ি। কিন্তু সেখানে ৫ পরিবারে পৌঁছেনি আলো। বিধায়ক (উত্তর করিমগঞ্জের) কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় রয়েছে। তাই তিন বছর থেকে দাবি জানিয়ে আসছেন বিধায়ককে। কিন্তু কবে নাগাদ সেই দাবি পূরণ হবে, তা জানা নেই তাঁদের।

একলাস উদ্দিন, সমীর উদ্দিন, সেলিম উদ্দিন, হাসিব উদ্দিনের বাড়ি কাঁটাতারের ওপারে দেওতলি গ্রামে। বর্তমানে রয়েছেন তাদের আট পরিবার। হিন্দুস্থান সমাচার-এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁরা জানান, রুটিরুজির জন্য আসতে হয় কাঁটাতারের বেড়ার গেট পেরিয়ে ভারতে। সকাল ৬-টা থেকে সন্ধ্যা ৬-টা পর্যন্ত খোলা থাকে গেট। তখন পরিচয়পত্র দেখিয়ে যাতায়াত করতে হয়। আবার সময়মতো ঘরে ফিরে যেতে হয়। সন্ধ্যার পর শরীর খারাপ বা জরুরি প্রয়োজন হলে বিএসএফকে জানাতে হয়। তাঁরা তখন গ্রামবাসীদের পৌঁছে দেন হাসপাতাল বা সংশ্লিষ্ট জরুরি প্রয়োজনীয় স্থলে। এবার তাঁরা ভোট দেবেন তিন কিলোমিটার দূরে গড়ে তোলা ভোটকেন্দ্রে।

লাতুকান্দির আব্দুল নুরের মতে, নির্বাচন নিয়ে আগে মাথাব্যথা ছিল না, এখনও নেই। ভোটাধিকারের পাশাপাশি রয়েছে রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু নিজভূমে পরবাসী আমরা। পাওয়া আর না-পাওয়ার অঙ্ক নেই তাঁদের। শুধু স্বপ্ন দেখছেন, দেশের নাগরিক হয়ে মন খুলে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার পাবেন।

চোখেমুখে বিষণ্ণতার ছাপ নিয়ে গোবিন্দপুরের বিপুল নমশূদ্র, টিটু নমশূদ্ররা জানান তাঁদের দুর্দশার কথা। বলেন, সরকারি কিছু প্রকল্পের যে সুবিধা লাভ করছেন সেটাই তাঁদের কাছে অনেক। কিন্তু একটি মাত্র গ্রামের রাস্তার বেহাল দশা। বাড়িঘরের অবস্থাও খারাপ। বর্ষার শুরুতেই বন্যার কবলে পড়ে গোটা গ্রাম। তখন পরিবারের মহিলা সদস্যরা আশ্রয় নেন ত্রাণ শিবিরে। আর বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের ভয়ে পুরুষরা নৌকায় বসে পাহারা দেন গ্রাম। জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ জানানো হয়। কিন্তু কোনও সুরাহা নেই। এভাবেই চরম দুর্দশায় কাটে তাঁদের দিনকাল।

গ্রামের জবাবালা নমশূদ্রের বাড়ি ভারত ভূখণ্ডে আর শৌচালয়ের অনেকটাই বাংলাদেশে। উঠোন দিয়ে টানা হয়েছে সীমান্তরেখা। ভারতের দিকে পাথরে লেখা রয়েছে ইন্ডিয়া। জবাবালা নমশূদ্রও বলেন, ভোট আসে, ভোট যায়, কিন্তু দুঃখ-দুর্দশা, দাবি জানানোর স্থান নেই তাঁদের। সীমান্তে বিএসএফ-এর চোখরাঙানি থাকলেও ভরসা সেই জওয়ানরাই। কেননা আপদে-বিপদে এগিয়ে আসেন তাঁরাই।

জোরের সঙ্গে জবাবালা জানান, তিনি ভারতীয়, জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন এই গ্রামে। মোদীজিকে শ্রদ্ধা করেন, অগাধ বিশ্বাস রয়েছে, হয়তো-বা তিনি তখন বেঁচে না-ও থাকতে পারেন। তবে দেশের প্রধানমন্ত্রী একদিন না-একদিন তাঁদের দাবি পূরণ করবেন, এই আশা বুকে বেঁধে রেখেছেন তাঁরা।

তাঁদের সবার একটাই দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন দেওয়া হোক, নতুবা সিঙ্গল লাইন ফেন্সিং ঘুরিয়ে দিলে কিছুটা তাঁদের সমস্যার সমাধান হবে। ঢুকে যাবেন ভারতের মূল ভূখণ্ডে। এমনিতেই সুবিধা বলতে কিছুই নেই। তবু তাঁদের অভিজ্ঞতা, প্রত্যাশাও রাখা বারণ। এর পরও ২৪-এর দিল্লি দখলের লড়াইয়ের আগে তাঁদের আশা, ভোটে অংশ নিয়ে হয়তো এবার দাবিদাওয়াগুলি পূরণ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *