BRAKING NEWS

শক্তিস্বরূপা জগজ্জননীই মঙ্গলকারী সংকল্পের সফলতার আধার

ডা: মোহন ভাগবত

সমাজে স্ব-এর বোধ ও গৌরব জাগিয়ে রাখা দরকার।

এই ‘স্ব’ আমাদের সকলকে সংযুক্ত করে। কারণ এটি আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের দ্বারা প্রাপ্ত সত্য উপলব্ধির প্রত্যক্ষ ফল। “সর্ব যদ্ভূতং যচ্চ ভব্যম্” হল একই চিরন্তন অবিনাশী উৎপত্তির একটি অভিব্যক্তি, সেজন্য শ্রদ্ধার সাথে নিজ বিশিষ্টতার উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যেকের বৈচিত্র্য, স্বতন্ত্রতাকে সম্মান করা এবং গ্রহণ করা উচিত। কেবল ভারতই সকলকে এই শিক্ষা দিতে সমর্থ। সবাই এক, তাই সবাইকে মিলেমিশে চলতে হবে, বিশ্বাসের বৈচিত্র্য আমাদের আলাদা করে না। সত্য, করুণা, অভ্যন্তরীণ বিশুদ্ধতা এবং তপস্যার সারমর্ম সমস্ত বিশ্বাসকে একত্রিত করে।

সমস্ত বৈচিত্র্যকে সুরক্ষা এবং অগ্রগতিকে সুনিশ্চিত করে যুক্ত রাখে। এটিই আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্ম বলে পরিচিত। এই দুই-চারটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে সমগ্র বিশ্বের জীবনকে সমন্বয়, আলাপ আলোচনা, সম্প্রীতি দেয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করতে পারার মত আমাদের সংস্কৃতি সকলকে একত্রিত করে, বিশ্বকে একটি পরিবার হিসাবে সংযুক্ত করতে অনুপ্রাণিত করে। সৃষ্টির পর থেকে আমরা সবাই বেঁচে থাকি, বেড়ে উঠি। ‘জীবনে যাবদ্ আদানম্ স্যাৎ প্রদানং ততোধিকম্’-এর ধারণা আমরা এর থেকেই পাই। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’-এর এই অনুভূতি এবং ‘বিশ্বম্ ভবত্যেকনীড়ম্’-এর এই মহান লক্ষ্য আমাদের পুরুষার্থ লাভে অনুপ্রাণিত করে।

আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের এই শাশ্বত প্রবাহ সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই উদ্দেশ্যে, এই রীতিতেই চলে আসছে। সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী রূপ, পথ ও শৈলী পরিবর্তিত হলেও মূল ধারণা, গন্তব্য ও উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে। আমরা এই পথে এই অবিরাম গতি অর্জন করেছি অগণিত বীরের সাহসিকতা ও আত্মনিবেদন, অগণিত কর্মযোগীর ভীমবৎ পরিশ্রম এবং জ্ঞানীদের কঠোর তপস্যার দ্বারা। আমরা সবাই তাদের আমাদের জীবনে অনুকরণীয় আদর্শের স্থান দেই। তিনি আমাদের সকলের গর্ব। তারা আমাদের সমান পূর্বপুরুষ এবং আমাদের একত্রীকরণের আরেকটি আধার।

তারা সকলেই আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি ভারতের জয়গান গেয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকেই, সকল প্রকার বৈচিত্র্যকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করা এবং একসাথে চলা আমাদের স্বভাব হয়ে উঠেছে; বস্তুগত আনন্দের চূড়ান্ত সময়ে থেমে না গিয়ে, আমাদের অন্তরের গভীরে খনন করে আমরা অস্তিত্বের সত্যতা পেয়েছি; বিশ্বকে নিজের পরিবার মনে করে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও ভদ্রতা সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন, এর কারণ আমাদের মাতৃভূমি ভারত। প্রাচীনকালে সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা এই ভারত মাতা আমাদেরকে যে নিরাপত্তা ও শান্তি দিয়েছিলেন তারই ফল তার চতুর্মুখী, সম্পূর্ণ নিরাপদ প্রাকৃতিক উপায়ে। সেই অখণ্ড মাতৃভূমির প্রতি একান্ত ভক্তিই আমাদের রাষ্ট্রীয়তার মূল ভিত্তি।

প্রাচীনকাল থেকেই ভূগোল, ভাষা, উপাসনার পথ, জীবনধারা, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও সমাজ হিসাবে, সংস্কৃতি হিসাবে, রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের জীবনপ্রবাহ অটুটভাবে চলে আসছে। এর মধ্যে সব বৈচিত্র্যের গ্রহণযোগ্যতা আছে, সম্মান আছে, নিরাপত্তা আছে, উন্নয়ন আছে। নিজের সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি, আগ্রাসন ও অহংকার ছাড়া আর কিছু ছাড়তে হয় না। সত্য, করুণা, অন্তর বাইরের পবিত্রতা এই তিনটির অনুশীলন ছাড়া আর কিছুর-ই অনিবার্য প্রয়োজন নেই। ভারতের ভক্তি, আমাদের একই পূর্বপুরুষদের উজ্জ্বল আদর্শ এবং ভারতের চিরন্তন সংস্কৃতি, এই তিনটি আলোকস্তম্ভের দ্বারা আলোকিত এবং প্রশস্ত পথে প্রেমের সাথে, একসাথে হাঁটা, এটি আমাদের ‘স্ব’, এটিই আমাদের রাষ্ট্রধর্ম।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ কর্তৃক সমাজের প্রতি আহ্বানের আশয় প্রথম থেকে এটাই ছিল। আজকের অভিজ্ঞতা হল, এখন সবাই সেই ডাক শুনতে ও বুঝতে প্রস্তুত। অজ্ঞতা, অসত্য, কুৎসা, ভয় বা স্বার্থপরতার কারণে সংঘের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রভাব কমে যাচ্ছে। কারণ সংঘের ব্যাপ্তি এবং সামাজিক আদানপ্রদান- অর্থাৎ সংঘের ক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীতে মান্যতা পাওয়ার জন্য সত্যকেও শক্তিশালী হতে হয়, এটাই জীবনের অদ্ভূত সত্য। পৃথিবীতে অশুভ শক্তিও আছে, তাদেরকে এড়াতে এবং অন্যদেরকেও বাঁচাতে সজ্জনের সংগঠিত শক্তি প্রয়োজন। উপর্যুক্ত রাষ্ট্র ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে থেকে সমগ্র সমাজকে সংগঠিত শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংঘ কাজ করছে। এটি হিন্দু সংগঠনের কাজ, কারণ উপরে উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় ধারণাকে হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা বলা হয়, আর সেটাই বাস্তব। অতএব সংঘ যারা উপরোক্ত রাষ্ট্র ধারণায় বিশ্বাসী সবাইকে অর্থাৎ হিন্দুসমাজের সংগঠন, হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজ এর সংরক্ষণ করে হিন্দু রাষ্ট্রের সর্বাত্মক উন্নতির জন্য ‘সর্বেষাম্ অবিরোধেন’

এবং তার শক্তিও রয়েছে, তখন লোকেরা হিন্দু রাষ্ট্রের কথা গুরুত্ব সহকারে শোনে। এই আশয়টিকে মাথায় রেখেই কেবল হিন্দু শব্দের বিরোধিতা করে অন্য শব্দ ব্যবহার করছেন অনেকে। তাদের বিষয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। অভিপ্রায়ের স্পষ্টতার জন্য আমরা আমাদের জন্য হিন্দু শব্দের উপর জোর দিতে থাকব।

তথাকথিত সংখ্যালঘুদের মধ্যে অকারণে একটা ভয় তৈরি করা হয় যে আমাদের বা সংগঠিত হিন্দুদের কাছ থেকে হুমকি রয়েছে। এমনটা কখনো হয়নি এবং হবেও না। সংঘের এমন স্বভাব ছিল না অথবা ইতিহাস ছিল না। অন্যায়, অত্যাচার, বিদ্বেষের আশ্রয় নিয়ে সমাজে গুন্ডামি করা লোকেরা সমাজের সাথে শত্রুতা করলে আত্মরক্ষা বা আপ্তরক্ষা করা সবার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। ‘না ভয় দেত কাহু কো না ভয় জানত আপ’ এর মতো হিন্দু সমাজকে দাঁড় করানো সময়ের দাবি। এটা কারো বিরুদ্ধে নয়। সংঘ দৃঢ়ভাবে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, ভদ্রতা এবং শান্তির পক্ষে দণ্ডায়মান।

এই ধরণের উদ্বেগ মাথায় রেখে, তথাকথিত সংখ্যালঘুদের কিছু ভদ্রলোক গত বছরগুলোতে দেখা করতে আসছেন। সংঘের কয়েকজন কার্যকর্তার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হচ্ছে, তা হতেই থাকবে। ভারত একটি প্রাচীন রাষ্ট্র, একটিই রাষ্ট্র। সেই পরিচয় ও ঐতিহ্যের স্রোতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আসুন আমরা সবাই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শান্তির সাথে রাষ্ট্রের নিঃস্বার্থ সেবা করি। একে অপরের সুখে-দুঃখে পরস্পরের সঙ্গী হই, ভারতকে জানি, ভারতকে বিশ্বাস করি, ভারতের জন্য তৈরি হই, এমনই একাত্ম ও সমরস রাষ্ট্রের কল্পনা সংঘ করে। এতে সংঘের অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা আগ্রহ নেই।

সম্প্রতি উদয়পুরে একটি জঘন্য ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। পুরো সমাজ হতবাক্ । সমাজের বৃহত্তর অংশ দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। গোটা সমাজ এই ধরণের ঘটনার মূলে জড়িত থাকে না। উদয়পুরের ঘটনার পর মুসলিম সমাজের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিও বিরোধিতা করেছিলেন। এই বিরোধিতা ব্যতিক্রম হয়েই থেকে যাওয়া উচিত নয়, বরং, এই প্রবৃত্তি বৃহত্তর মুসলিম সমাজের স্বভাবে পরিণত হওয়া উচিত। হিন্দু সমাজের একটি বৃহৎ অংশ এরকম ঘটনা
ঘটলে হিন্দুকে এমন ঘটনার জন্য অভিযুক্ত করা হলেও, তার বিরোধিতা ও নিষেধ মুখরতার সাথে প্রকাশ করে।

উস্কানি যাই হোক, যেখান থেকেই হোক না কেন, আইন ও সংবিধানের মর্যাদার মধ্যে থেকে সকলকে সর্বদা নিজের বিরোধ প্রকাশ করা উচিত। সমাজ সংযুক্ত হোক যেন না ভাঙে, ঝগড়া না করে, বিচ্ছিন্ন না হয়। মন-বচন-কর্মের মাধ্যমে এমনই ভাব মনে রেখে সমাজের সকল সজ্জনদের মুখর হতে হবে। আমরা দেখতে আলাদা এবং বিশিষ্ট বলে আমরা আলাদা, আমাদের বিচ্ছেদ দরকার, আমরা এই দেশ ও তার মূল জীবনধারা এবং পরিচয় নিয়ে চলতে পারি না; এই অসত্যের কারণে, ‘ভাই টুটে, ধরতী বিখরে মিটে ধর্মস্থান’ এই বিভাজনের বিষাক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ সুখী হননি। আমরা ভারতের, ভারতীয় পূর্বপুরুষের, ভারতের সনাতনী (চিরন্তন) সংস্কৃতির, সমাজ ও রাষ্ট্রিয়তার দিক থেকে এক, এটাই আমাদের উদ্ধারক মন্ত্ৰ ।

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় উত্থানের শুরুতে, স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের ভারতমাতাকেই একমাত্র আরাধ্যারূপে মেনে কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। মহর্ষি অরবিন্দ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, প্রথম স্বাধীনতা দিবস এবং তার নিজের জন্মদিনে ভারতবাসীকে একটি বার্তা দিয়েছিলেন। এতে তার পাঁচটি স্বপ্নের উল্লেখ রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা ও ঐক্যের ভাবনা সেখানে প্রথম ছিল। সাংবিধানিক পদ্ধতিতে রাজ্যগুলিকে একীভূত করার বিষয়ে তিনি এক অখন্ড ভারত গঠনের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে ছিলেন।

কিন্তু দেশভাগের ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে এক চিরন্তন রাজনৈতিক খাদ তৈরি হয়েছে, যা ভারতের ঐক্য, অগ্রগতি ও শান্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেজন্য তাঁর চিন্তা ছিল। যেভাবেই হোক না কেন, বিভাজন রদ হওয়ার পর ভারত যেন এক হয়, এইরূপ তীব্র আকাঙ্ক্ষা তিনি প্রকাশ করতেন। কারণ তিনি জানতেন যে তাঁর পরবর্তী সমস্ত স্বপ্নের- এশিয়ার দেশগুলির মুক্তি, বিশ্বের একতা, ভারতের আধ্যাত্মিকতার জন্য বিশ্বব্যাপী অভিমন্ত্রণ এবং বিশ্বে অতিমানসের জগতে অবতরণের- বাস্তবায়নের ফলে ভারতই প্রাধান্য পাবে। তিনি জানতেন যে এটি উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রাধিকার থাকবে। তাই তার কর্তব্যের বার্তা খুবই স্পষ্ট “রাষ্ট্রের ইতিহাসে এমন একটি সময় আসে যখন ভাগ্য তার সামনে একটিই কাজ, একটিই লক্ষ্য রাখে, যার জন্য অন্য সবকিছু, তা সে যতই উন্নত বা উদাত্ত হোক না কেন, সবকিছুই সমর্পণ করতে হয়। আমাদের মাতৃভূমির জন্য এখন এমন এক সময় এসেছে, যখন তাঁর সেবার চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই। যখন অন্য সব কিছু তাঁরই জন্য সম্পাদন করতে হয়।

আপনি যদি অধ্যয়ন করেন, তবে তাঁরই জন্য অধ্যয়ন করুন। আপনার দেহ, মন এবং আত্মাকে তাঁর সেবা করার জন্য প্রশিক্ষণ দিন। দেশের জন্য বাঁচার কারণেই নিজের জীবিকা অর্জন করুন। আপনি সমুদ্র পেরিয়ে বিদেশে যাবেন, যাতে সেখান থেকে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে তাঁর সেবা করতে পারেন। তাঁর গৌরবের জন্য কাজ করুন। তিনি যাতে আনন্দে থাকেন, তার জন্য আপনি দুঃখে সহ্য করুন। এই একটি উপদেশে সবকিছু এসে গেছে।” 

(সরসঙ্ঘচালক ডা: মোহন ভাগবতের বিজয়া উত্সব-২০২২ উপলক্ষ্যে দেওয়া বক্তৃতা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *