মাতৃ দুগ্ধ অমৃত সমান

একটি সুস্থ প্রজন্ম আগামীকাল আপনার আজকের বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে। বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ ২০২১-এর স্লোগান হল বুকের দুধ খাওয়ানো: জীবনের ভিত্তি। বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ থিম বুকের দুধ খাওয়ানোকে রক্ষা করে: একটি যৌথ দায়িত্ব, স্তনপান স্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকার নিশ্চিত করার জন্য বুকের দুধ খাওয়ানো অন্যতম কার্যকর উপায়।

সৌমিত কুড়ি

যাইহোক, ৩টি শিশুর মধ্যে প্রায় ২টি সুপারিশকৃত ৬ মাসের জন্য একচেটিয়াভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় না – এই হার যা ২ দশকে উন্নত হয়নি। …… WHO

১. বুকের দুধ খাওয়ানো হল প্রথম মৌখিক টিকা, কারণ এতে IgA রয়েছে।

২. বুকের দুধে শিশুর জন্য সব পুষ্টি থাকে এবং সহজেই হজম হয়। এটি পরিষ্কার এবং নিরাপদ।

৩. বুকের দুধ শিশুকে ডায়রিয়া, জন্ডিস ইত্যাদি সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে

৪. অনাক্রম্যতা এবং আইকিউ স্তর বৃদ্ধি।

তাই বেঁচে থাকার এবং শিশুর সুস্বাস্থ্য অর্জনের জন্য বুকের দুধ খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ।

একটি সুস্থ শিশু পরিবারের পাশাপাশি সমাজ থেকেও বোঝা কমায়।

তাই দীর্ঘমেয়াদে বুকের দুধ খাওয়ানো জাতির জন্য একটি সুস্থ শিশু গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ প্রতি ১ থেকে ৭ আগস্ট উদযাপিত হয় এবং ১৯৯২ সালে বার্ষিক থিম দিয়ে শুরু হয়।

অনুকূল শিশু এবং ছোট শিশু খাওয়ানোর (আইওয়াইসিএফ) অনুশীলনের জন্য WHO এবং ইউনিসেফের সুপারিশ।

১. জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রাথমিক সূচনা।

২. জীবনের প্রথম ছয় মাসের জন্য এক্সক্লুসিভ বুকের দুধ খাওয়ানো।

৩. ছয় মাস পুষ্টিকর পর্যাপ্ত এবং নিরাপদ পরিপূরক প্রবর্তনের সাথে সাথে দুই বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ রাখুন।

বুকের দুধ খাওয়ানো সবচেয়ে ভালো প্রাকৃতিক খাবার। এটি শিশুদের জন্য সবচেয়ে সস্তা, নিরাপদ এবং সর্বোত্তম প্রতিরক্ষামূলক খাদ্য। এটি শিশুদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য কারণ এতে ল্যাকটোজ এবং গ্যালাকটোজের উচ্চ শতাংশ রয়েছে যা গ্যালাক্টোসেরেব্রোসাইডের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ।এটি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে যা হাড় বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বুকের দুধে অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে যা নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন মোট দুধের পরিমাণ 600 থেকে 700 মিলি। যা শিশুর জন্য যথেষ্ট। স্তন দুধ সহজে হজম হয়। স্তনের দুধে লিপেজ এনজাইম চর্বি হজমে সাহায্য করে এবং বিনামূল্যে ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদান করে।

বুকের দুধের বিভিন্ন গঠন হল কোলস্ট্রাম যা প্রসবের পর প্রথম তিন দিনের মধ্যে নিসৃত হয়। এটি ঘন হলুদ এবং অল্প পরিমাণে চর্বি, অ্যান্টিবডি, প্রোটিন, ল্যাকটোফেরিন থাকে। নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ানো শেষ।

নিয়মিত এবং ঘন ঘন এবং চাহিদা অনুযায়ী খাওয়ানোও নবজাতকের অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার হ্রাসের .

বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে পরিসংখ্যান ….

ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ৪ অনুসারে .. যা ২১ জানুয়ারী ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে …. ৩ বছরের কম বয়সী ৪১.৬% শিশু জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো হয়েছে, যেখানে ৬ মাস বয়সের ৫৪.৯% শিশুকে বিশেষভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো হয়েছে

ভারতে বুকের দুধ খাওয়ানো অপ্রতুল, কারণ মাত্র ৫৫% শিশু ০ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত বিশেষভাবে বুকের দুধ পান করে এবং ৪১% জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে পারে যা জীবনের সুবর্ণ সময় হিসাবে পরিচিত।

বুকের দুধ খাওয়ানো এবং কোভিড পজিটিভ মা ….. ডব্লিউএইচও এর নিয়ম অনুসারে যে কোভিড আক্রান্ত মায়েরা ভাইরাস বহন করার সন্দেহে তাদের বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ানো বেছে নিতে পারে যদি তারা ডাবল মাস্ক, সঠিক হাতের স্বাস্থ্যবিধি ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রতিটি নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুসরণ করে। আজ অবধি পাওয়া যায় যে বুকের দুধের মাধ্যমে কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকি খুবই কম।

স্তন্যদানকারী মায়েরা এবং কোভিড ভ্যাকসিন ….. স্তন্যদানকারী মানুষ কোভিড টিকা পেতে পারে। বুকের দুধ খাওয়ানো মা যারা কোভিড ভ্যাকসিন পেয়েছেন তাদের বুকের দুধে অ্যান্টিবডি আছে যা তাদের বাচ্চাদের সুরক্ষায় সাহায্য করতে পারে। বুকের দুধ খাওয়ানো একটি প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য পরিকল্পনা। এটা শিশুর অধিকার।

মাতৃ দুগ্ধ অমৃত সমান,মাতৃদুগ্ধের বিকল্প নেই। নবজাতকের পুষ্টি, বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য যাবতীয় প্রয়োজন মায়ের দুধ থেকে পাওয়া যায়। তাই জন্মের পরে, যত দ্রুত সম্ভব নবজাতককে মায়ের দুধ পান করানো দরকার। শিশুর জন্মের পরে, প্রথম ঈষৎ হলুদ বর্ণের যে গাঢ় দুধ নিঃসৃত হয়, তাকে ‘কলোস্ট্রাম’ বলা হয়। ‘কলোস্ট্রাম’ নবজাতকের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। কারণ, এতে পুষ্টিগুণ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের ‘ইমিউনোগ্লোবিউলিন’ থাকে, যা নবজাতককে ভবিষ্যতে কয়েকটি রোগ থেকে মুক্ত রাখে। এ সমস্ত বিষয় মাথায় রেখেই স্তন্যপানে সচেতনতা আরও বাড়াতে অগস্টের প্রথম সপ্তাহটি ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধপান সপ্তাহ’ হিসেবে পালিত হয়।মাতৃস্নেহ এবং মাতৃদুগ্ধ যে কোনও শিশুরই বেড়ে ওঠার পরিপূরক। মা এবং ছানা দুজনেই সুস্থ থাকে যদি স্তন্যপান করায় এবং করে। মাতৃদুগ্ধই বাচ্চার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। ভেতর থেকে শক্তিশালী করে। অন্যদিকে স্তন্যপান করালেই কমে ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রনণতা। এছাড়াও প্রেগন্যান্সি পরবর্তী ওজন কমে যদি নিয়মিত স্তন্যপান করানো যায়। স্তন্যপান করালে স্তনের আকার বিকৃত হয় এরকম ধারণা মোটেই ঠিক নয়।ছ’মাস বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে কেবলমাত্র বুকের দুধেই খাওয়ানো দরকার। এমনকি, এ সময়ে জলের দরকার হয় না। ছ’মাসের পর থেকে পরিপূরক আহারের সঙ্গে সঙ্গে কমপক্ষে দু’বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত।


ভ্রান্ত ধারণা………
বুকের দুধ পান করানো নিয়েও প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা, অন্ধ বিশ্বাস, চিরাচরিত প্রথা, কুসংস্কার সমাজে রয়ে গিয়েছে।স্তন্যদাত্রী মা’র পুষ্টি ঠিকমতো হলে যেমন প্রসবের পরে শরীরের ক্ষয়পূরণও হয়, তেমনই দুধ নিঃসরণেও কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু ভ্রান্ত ধারণার বশে এখানেও কার্পণ্য করা হয়। ধারণাটি হল, মা অতিরিক্ত খাবার খেলে, মায়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুরও বদহজম হবে। কারণ, সে মায়ের দুধ খায়। তাই প্রসূতিকে কোনও আমিষ জাতীয় খাবার সচরাচর দেওয়া হত না।

মায়ের দুধের গুণ!
শিশুর জন্য তার মায়ের দুধ অমৃতের মতো। পৃথিবীর আলো দেখার পর প্রথম ৬ মাস মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য সবথেকে ভালো। বুকের দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শিশুর ঘ্রাণশক্তি বাড়ায় ও স্বাদ বিচারের ক্ষমতাও তৈরি করে। মায়ের খাদ্যাভ্যাসে রদবদলের সাথে সাথে বুকের দুধের স্বাদের পরিবর্তন ঘটে, তাই শিশু একটু একটু করে নানারকম স্বাদের সাথে পরিচিত হতে পারে। মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্ক নিবিড় করে এই স্তন্যপান করানো। মায়ের দেহের সংস্পর্শে এসে, মায়ের আদর ও নিজের পুষ্টি দুইই গ্রহণ করে শিশু, আর নিজের পরম নির্ভরতার জায়গাটি খুঁজে পায়।

মায়ের দুধের যত গুণ!

১.শালদুধ : শিশু জন্মের কিছুক্ষণ পর মায়ের যে দুধ আসে তাকেই শালদুধ বলা হয়। এর পরিমাণ কম। কিন্তু শিশুর দেহে পুষ্টি ও নানা রোগ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ওষুধ। তাই কোনও অবস্থাতেই এই দুধ বাদ দেওয়া উচিত নয়। শিশু জন্মের কয়েক দিনের মধ্যেই শাল দুধ শেষ হয় এবং স্বাভাবিক দুধ আসতে শুরু করে।

২.পুষ্টিগুণ : মায়ের দুধে প্রায় সব ধরনের ভিটামিনই থাকে। আর এই ভিটামিন খুব সহজেই শিশুর শরীর গ্রহণ করে নেয়। এ ছাড়াও মায়ের দুধে আছে শিশুর বিকাশে সবচেয়ে জরুরি উপাদান, প্রোটিন। বুকের দুধের ক্যালসিয়াম ও জিংক শিশুর মজবুত হাড় গঠন করতেও সাহায্য করে।

৩.রোগ প্রতিরোধ:মায়ের দুধে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি থাকে। যে কারণে যারা পর্যাপ্ত মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে তাদের শরীরের অ্যান্টিবডি শক্তি অন্যদের চেয়ে গড়ে ১০ শতাংশ বেশি হয়! এ ছাড়াও এর উপাদান কিডনির সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। স্নায়ুতন্ত্রের দ্রুত বিকাশ ঘটায় ও ক্যান্সার প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৪.হজমশক্তি বৃদ্ধি :মায়ের দুধ শিশুর হজমশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়ক। শিশু এই খাবার খুব সহজেই হজম করতে পারে। মায়ের দুধে থাকা সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল শিশুর দেহে সহজেই প্রবেশ করে। তা বাদে মায়ের দুধে মাত্র ১৬ শতাংশ ফ্যাট থাকে। নবজাতকের জন্য তাই এর বিকল্প কিছু হতেই পারে না।

মায়ের দুধের উপকারিতা, পুষ্টিগুণ ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গর্ভকালীন অবস্থায় মা-সহ পরিবারের সকলকে সম্যক ভাবে বোঝানো দরকার। শিশু জন্মানো মাত্রই যেন বুকের দুধ দেওয়া হয় এবং যত দীর্ঘদিন সম্ভব তা পান করানো সম্ভব হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।


(লেখক পরিচিতি : সৌমিত কুড়ি। সিএইচও, এনএইচএম.ত্রিপুরা। ভারতের প্রশিক্ষিত নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *