নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৩ ফেব্রুয়ারি৷৷ আবারও ফুটে উঠল রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল চিত্র৷ রোগী কল্যাণ সমিতির
![শুক্রবার আগরতলায় রোগী কল্যাণ সমিতির কাজকর্ম নিয়ে পর্যালোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বাদল চৌধুরী৷ ছবি নিজস্ব৷](https://jagarantripura.com/wp-content/uploads/2017/02/RKS-Health-300x201.jpg)
ক্রিয়াকান্ড দুর্ভাগ্যজনক বলে উষ্মা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী বাদল চৌধুরী৷ শুক্রবার আগরতলায় রোগী কল্যাণ সমিতির কাজকর্ম নিয়ে পর্যালোচনা সভায় বিভিন্ন হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেহাল দশার পেছনে সমিতিই দায়ী তা প্রমাণিত হয়েছে৷ তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করার পাশাপাশি ক্ষোভের সুরে বলেন, যাদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা পালন না করলে গরিব মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছাবে কিভাবে৷
এদিন, এই পর্যালোচনা সভায় উঠে আসে রাজ্যের ৮টি জেলায় বিভিন্ন হাসপাতালে এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগী কল্যাণ সমিতিকে যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয় তার অধিকাংশটাই অব্যয়িত থেকে যাচ্ছে৷ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দপ্তরের তরফে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঊনকোটি জেলায় রোগী কল্যাণ সমিতির কাজ ভীষণ হতাশাজনক৷ অর্থ খরচ করার ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য অন্যান্য জেলার তুলনায় খুবই নগণ্য৷ ঊনকোটি জেলায় মোট বরাদ্দ অর্থের মাত্র ১৯ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের রোগী কল্যাণ সমিতিগুলি৷ দক্ষিণ জেলা, খোয়াই জেলা, সিপাহীজলা জেলা, উত্তর ত্রিপুরা জেলা এবং ধলাই জেলায় বরাদ্দ অর্থের খরচের হারও ভীষণ হতাশাজনক৷ প্রতিবেদনের উল্লেখিত তথ্যে জানা গেছে, বরাদ্দ অর্থের দক্ষিণ জেলায় ২৭ শতাংশ, খোয়াই জেলায় ৩৪ শতাংশ, সিপাহীজলা জেলায় ৩৭ শতাংশ, উত্তর ত্রিপুরা জেলায় ৪১ শতাংশ এবং ধলাই জেলায় ৪৬ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে৷ পশ্চিম জেলার অবস্থাও হতাশাজনক৷ এই জেলার রোগী কল্যাণ সমিতিগুলি মোট বরাদ্দ অর্থের মাত্র ৪২ শতাংশ খরচ করতে সক্ষম হয়েছে৷ কেবলমাত্র গোমতী জেলায় রোগী কল্যাণ সমিতিগুলি সর্বাধিক ৭৫ শতাংশ অর্থ খরচ করতে পেরেছে৷ মূলত, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে বসার জায়গা, পানীয় জল সহ অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি ব্যবস্থা করার জন্য রোগী কল্যাণ সমিতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে এর কোনটারই পরিষেবা পাচ্ছেন না রোগীরা৷ এই পর্যালোচনা সভায় উঠে আসে বিভিন্ন হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গর্ভবতী মায়েরা দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টিও৷ তাছাড়া স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নাগরিক পরিষেবার অন্তর্গত বিভিন্ন তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও ঘাটতি উঠে এসেছে৷ বিভিন্ন হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কিচেন গুলিরও বড়ই করুণ দশা৷ সম্প্রতি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের টিম বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে পরিদর্শন করে এই চিত্র দেখতে পেয়েছেন৷ এদিন পর্যালোচনা সভায় এবিষয়টিও আলোচনায় ছিল৷ উদ্বেগের বিষয় হল, স্বাস্থ্য দপ্তরের সাথে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির যে সেতু তৈরি হয়ে রয়েছে তাতেই ফাটল দেখা দিয়েছে৷
এদিন, এই সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রধান সচিব রাকেশ সরওয়াল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাজ্যের সমস্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে প্রসব করার সুযোগ নেই৷ ফলে, জেলা হাসপাতালগুলির ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে৷ জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের মিশন অধিকর্তা এস কে যাদবও হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন৷ তিনি বলেন, স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে পর্যাপ্ত ওষুধের মজুত থাকছে না৷ অথচ বিষয়টি রোগী কল্যাণ সমিতিকেই দেখার কথা৷ এদিন তিনি উদ্বেগের সুরে বলেন, প্রসবকালীন মৃত্যু একমাত্র এক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে অন্য হাসপাতালে রেফারের কারণেই ঘটছে৷ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রসব করানো সম্ভব না হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র খোলার কোন যৌক্তিকতা নেই৷
অবশেষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বাদল চৌধুরী এদিন রোগী কল্যাণ সমিতির ওপর সমস্ত রাগ উগরে দিতে গিয়ে চিকিৎসকদেরও একহাত নিয়েছেন৷ তাঁর বক্তব্য, চিকিৎসকরা যদি প্রসব করাতে না পারেন তাহলে চিকিৎসাবিদ্যা গ্রহণ করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই৷ এদিন তিনি বলেন, রোগী কল্যাণ সমিতির ক্রিয়াকান্ড বড়ই দুর্ভাগ্যজনক৷ তার থেকেও হতাশার বিষয় চিকিৎসকরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না ঠিকভাবে৷ রাজ্যের প্রত্যেক মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই জেলা এবং মহকুমা হাসপাতালের পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে৷ অথচ দেখা যাচ্ছে, প্রসব যন্ত্রণায় কাতর গর্ভবর্তীদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে মহকুমা কিংবা জেলা হাসপাতালগুলিতে৷ পাশাপাশি তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ মিলছে চিকিৎসকরা তাদের কোয়ার্টারে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন এবং সময়মত হাসপাতালে কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন না৷ তাঁর বক্তব্য, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার ক্ষেত্রে সরকারের কোন আপত্তি নেই৷ কিন্তু সরকারি কোয়ার্টার ব্যবহার করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বরদাস্ত করা হবে না৷ তিনি এদিন অবাক হয়ে বলেন, আগরতলা শহরে চিকিৎসকরা রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত থাকেন৷ তাদের উদ্দেশ্যে কটাক্ষের সুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর বক্তব্য, ঐ চিকিৎসকরা মানুষ নাকি অমানুষ বলা মুশকিল৷ কারণ, তাদের ভগবানও বলা যাচ্ছে না৷ বিভিন্ন হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রোগী কল্যাণ সমিতির হতাশাজনক কাজকর্ম চিকিৎসকদের গাফিলতির কারণেও হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন৷
এদিন তিনি বলেন, রোগী কল্যাণ সমিতি তাদের দায়বদ্ধতা কোন মতেই এড়াতে পারেন না৷ জনপ্রতিনিধিরা তাদের দায়দায়িত্ব পালন না করলে রোগীরা উপকৃত হবেন কিভাবে প্রশ্ণ ছঁুড়ে দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী৷ অর্থখরচ নিয়েও রোগী কল্যাণ সমিতির তীব্র সমালোচনা করেন তিনি৷ পাশাপাশি বলেন, রোগীদের পরিষেবা সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা সঠিকভাবে পালন না করলে গরিব মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়৷ যদি বরাদ্দ অর্থের খরচের চেহারা এমনটা হয় তাহলে রোগী কল্যাণ সমিতিকে টাকা দিয়ে কোন লাভ নেই৷
এদিন তিনি উদ্বেগের সুরে আরো বলেন, রাজ্যে শিশু মৃত্যুর হার শূন্যের কোটায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না৷ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসকরা নরমাল ডেলিভারি করতে সাহস নেন না৷ তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, প্রসব করাতে না পারলে চিকিৎসক কেন হয়েছেন৷ এজন্য তিনি চিফ মেডিক্যাল অফিসার এবং সাব ডিভিশন মেডিক্যাল অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছেন নরমাল ডেলিভারি করাতে সাহস দেখাতে পারেন না এমন চিকিৎসকদের অবিলম্বে খঁুজে বের করতে হবে৷ তাঁর বক্তব্য, হাসপাতালগুলিতে ১০০ শতাংশ প্রসব সুনিশ্চিত করতেই হবে৷ এদিন তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজকর্মেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ আশা এবং এমপিডব্লিউ কর্মীরা ঠিক ঠিকমত কাজ করছেন না এমন বহু অভিযোগ স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে জমা পড়েছে৷ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এখন থেকে এধরনের কোন অভিযোগ বরদাস্ত করা হবেনা৷ অভিযোগের সত্যতা মিললে দপ্তর চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেবে৷ তাঁর বক্তব্য, প্রত্যেক মানুষের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতেই হবে৷ আশা কর্মী এবং এমপিডব্লিউদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতেই হবে৷ রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির হালহকিকতের দিকেও গুরুত্ব দিয়ে নজর দিতে হবে৷