কলকাতা, ১০ সেপ্টেম্বর (হি. স.): ঢাকে কাঠি পড়তে মাত্র আর কয়েকটা দিন বাকি। শারদোৎসবের প্রস্তুতি তাই তুঙ্গে। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে বছর দুই পরে এ বছর আবার পুজোয় মেতে উঠবে মর্ত্যবাসী। এত আনন্দের মধ্যেও যেন মন ভাল নেই শোলা শিল্পীদের। তবু ব্যস্ততার মধ্যে শুরু হয়েছে তাঁদের প্রহরগোণা।
গোটা দেশে শোলাশিল্পের জন্য খ্যাত একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ। এই শিল্পীদের পীঠস্থান বনকাপাসি। পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লকের কৈচর-২ পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বনকাপাসি গ্রামের প্রায় ১০০টি পরিবার যুক্ত শোলা শিল্পের সঙ্গে। পুজোর সময়টা শিল্পীদের প্রধান মরসুম। দুর্গা থেকে শুরু করে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত দেবীর সাজ তৈরির কাজ হয় বনকাপাসিতে। থিম পুজোর বাড়বাড়ন্ত হলেও শোলার সাজের চাহিদা এখনও আগের মতোই আছে। কিন্তু এবার কাঁচামালের টানাটানি। মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম হস্তশিল্প শোলা শিল্প। বারুইপাড়া-পলতাগড় পঞ্চায়েত এলাকায় চার পুরুষের বেশি বাস কিছু শোলা শিল্পীর। তাঁদেরও একই সমস্যা।
কিন্তু, শোলার উৎপাদন কমে গেলে শিল্প চলবে কী ভাবে। চিন্তার ভাঁজ প্রসাদ ঘোষের কপালে। তাঁর বয়স ৪৮। শৈশব থেকেই শোলার কাজ করেন। তিন পুরুষের শোলাশিল্পী। এই প্রতিবেদককে বলেন, “এই চত্বরে শোলার কাজ করেন প্রায় ১০০ ঘর। তার মধ্যে আমাদের মত ২০ ঘর বছরভর শোলার কাজ করেন। বাকি ৮০ ঘর মরশুমি। এবার ভাল বৃষ্টি না হওয়ায় জলাভূমি শুকিয়ে গিয়েছে। ফলে শোলাচাষে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কমে গিয়েছে শোলার উৎপাদন। অন্য কাঁচামালের দামও বেজায় বেড়ে গিয়েছে। আমরা অসহায়!“
শোলার কাজে কিছু আবশ্যিক জিনিস লাগে। যেমন বিশেষ ধরণের কাগজ। প্রসাদবাবু বলেন, “এই কাগজ ফি বছর লাগে প্রায় ১০০ রিম। বছর দুই আগে দাম ছিল রিমপিছু ৬০০ টাকা। এবার বেড়ে হয়েছে ৮৪০ টাকা। চুমকি লাগে ১০০ কেজির মত। এর দাম কেজিপিছু ২২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা। রাংতার রিম বেড়ে হয়েছে ২ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা। অন্যান্য খরচও বেড়েছে। কিন্তু আমরা দাম পাচ্ছি না।দুর্গাপুজোর সাজে শোলার সঙ্গে আরও অনেক কিছু ব্যবহার করা যায়। কিন্তু, জগদ্ধাত্রী পুজোর সাজ পুরোপুরি শোলা দিয়েই করতে হয়। পরিমাণে অনেক বেশি শোলা লাগে। কিন্তু সবসময় চাহিদা মতো শোলা পাওয়া যায় না।’’
শোলা গাছ কিনে এনে তার উপরের খোসা ছাড়িয়ে সাদা শোলা বার করা হয়। তা দিয়েই শোলার মুকুট, সাজ তৈরি করেন শিল্পীরা। বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে নদিয়ার ডিঙেল গ্রামে ১০০ বছরের ওপর শোলাচাষের সঙ্গে যুক্ত এক ঘোষ পরিবার। এই পরিবারের শরিক বছর বাইশের সুব্রত ‘জয়গুরু সাজভাণ্ডার’-এর মালিক। তিনি জানান, “আমরা চাষও করি। শোলার কাটিং করে শিল্পকর্মও করি। শোলা দিয়ে নানা ধরনের মডেল তৈরি হয়।“
শোলাচাষের সঙ্কটের কথা জানাতে গিয়ে সুব্রত বলেন, “সাধারনত বৈশাখের শেষে বিলের ধারে আমাদের বীজ ফেলতে হয়। জলের মধ্যে লতানে গাছ হয়। মাস দুই লাগে ব্যবহারের উপযোগী হতে। কিন্তু এবার জলাভাবে ফলন হয়নি। জমিদারের জমির অংশে খাল কেটে জল এনে কেউ কেউ শোলা ফলাতে পেরেছেন। কিন্তু বাকিরা সত্যিই সঙ্কটে।ইদানীং পেশা থেকে মুখ ফেরাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম।”
শোলার কদম ফুল লাগে মঙ্গল ঘটে, মুকুট আর চাঁদমালায়। দুর্গাপুজোর সময় সেই কদম ফুলের চাহিদা থাকে অনেক বেশি। কাঁচা শোলা রোদে শুকিয়ে মাপ মত কেটে প্রথমে খোসা ছাড়ানো হয়।এরপর দুধ সাদা শোলা কেটে নানান মাপের ফুল তৈরি হয়। চাহিদা মত রঙও লাগানো হয়। বাড়ি থেকে পাইকারি হারে বিক্রি হয় এই শোলার ফুল।
দুই ২৪ পরগনা ও বাংলাদেশ লাগোয়া বেশ কিছু এলাকায় শোলা গাছের চাষ হয়। জোগান কম থাকায় বাড়ছে দাম। আগে এক বান্ডিল শোলা কিনতে ১ হাজার টাকা খরচ করতে হত। এখন ৪ হাজার টাকা খরচ করেও ওই শোলা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে শোলার শিল্পকর্মের দাম বাড়ছে।
কয়েক বছর ধরে শোলার জায়গা দখল করেছিল সস্তার থার্মোকল। প্রতিমার সাজেও আসছিল পরিবর্তন। থার্মোকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল শোলার কাজের। প্রসাদ ঘোষ এই প্রতিবেদককে বলেন, “সরকার এবার কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে থার্মোকোলের ওপর। কিন্তু অনাবৃষ্টির জেরে ঘোর সমস্যায় বনকাপাসির শোলা শিল্পীরা। কোথাও কোথাও সাবেকি শোলার কাজের বরাত পেলেও জিনিসের যা বাজার মূল্য বেড়েছে তাতে খুব সঙ্কটে পড়েছি।”