BRAKING NEWS

উৎপাতের আরেক নাম চিন

ড. রাজলক্ষ্মী বসু

যখনই কোনো সমস্যার করাল ছায়া বিশ্বে এসেছে তখনই কিছু না কিছু নতুন কলকাঠি চিন নেড়েছে। সারা বিশ্ব এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল যে চিন আসলে একটা অ- গনতান্ত্রিক পরোক্ষ স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র যারা নানান পদ্ধতিতে অন্য দেশের এবং বিশ্বের গনতন্ত্রের ভিত্তি টলোমলো করতে প্রস্তুত। চিনের নানা দূরভিসন্ধি দেখে মনে হচ্ছে স্টিফেন ল্যাভিস্কে এবং ড্যানিয়েল জিবলেটের সেই বইটার কথা ” How Democracies Die” — সত্যিইতো একটা রাষ্ট্র কি করে অনাদরে গনতন্ত্রের গলা চেপে ধরে! তাও আবার অন্য রাষ্ট্রের গলা! সেখানে লেখক বলছেন ঠান্ডা মাথায় যারা গনতন্ত্র হত্যা করে তারা আপাত অদৃশ্য এবং মিলিটারি যুদ্ধের মতো রক্তপাত ঘটায় না। চিন বোধহয় এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিঃশব্দী গনতন্ত্র ঘাতক। ওই দেশটাকে দেখে এই জিজ্ঞাসা জাগে কর্পোরেট ক্যাপিটালিজম এবং গনতন্ত্র কি সত্যিই জড়াজড়ি করে থাকতে পারে? করোনা অতিমারী , তার সাথে আবার দোসর ওমিক্রন, ঠিক এই সময়েই চিন আবার এক ভারত সার্বভৌমত্ব বিরোধী পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিল। ২০০৫ সালে ভারত এবং চিনের যে সীমান্ত বিষয়ক চুক্তি হয়, তার ৮ নং অনুচ্ছেদ বলছে, সীমান্তে যে দেশের জনগোষ্ঠী বিদ্যমান তাদের উচ্ছেদ করা যাবেনা। সম্প্রতি চিন নিজেও তার দেশে এক আইন বলবৎ করেছে যা চিনের সীমান্ত আগ্রাসন নীতিকে আরো কিছুটা প্রশ্রয় দিচ্ছে। ভূটান এবং অরুনাচল সীমান্তের ছোটো ছোটো গ্রামগুলো কব্জা করাই এখন ওদের লক্ষ্য এবং তারা দাবি করছে এইসব গ্রামে চিনারাই থাকে। চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিচিয়ানের দাবী অরুণাচলের ঝানগামের এক বড় অংশ তিব্বতের অংশ। তারা এই অঞ্চলের নাম মান্দারিন ভাষায় করতে উদগ্রীব।

এখন জিজ্ঞাসা ঠিক এই মহামারী সময় আর তারমধ্যেই কেন এতো সীমান্ত অসহিষ্ণুতার তোড়জোড়? চিন সীমান্ত সমস্যা তখনই করে যখন সীমান্তের ওপারে নিজের ভূখন্ডে বেশ বড়সড় কোনো না কোনো সমস্যা ঘটে। এই যেমন ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকে এক গভীর সমস্যা দানা বাঁধে ওখানে। Evergrande তো মুখ তুবড়ে পরেছে। যা কিনা ও দেশের সবচেয়ে বড় ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট বিল্ডার তা আজ রাষ্ট্রকে গ্যারান্টি অবলিগেশান দিতে অক্ষম। ঠাকুর ঘরে কে আমিতো কলা খাইনির সুরে আগেভাগেই China Banking and insurance Regulatory Commission ( CBIRC) এক সাংবাদিক বিজ্ঞপ্তিতে বলে ; এর ফলে চিনের ব্যাঙ্কিং সেক্টরে কোনো প্রভাব পরবে না। কিন্তু এমন কথাকি বিশ্বাসের রাস্তার খানাখন্দ বোজাতে পারছে? নানা প্রশ্নের গর্তে যে ওদের ছেলেভোলানো বিজ্ঞপ্তি দম ফেলতে পারছে না। উত্তর খুঁজতে এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুঁটছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের একদল বলছেন এই সঙ্কট যেন Lehman Brothers , ২০০৮ এর মুহূর্ত মনে করিয়ে দিচ্ছে। যেন এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি। Evergrande বিপর্যস্ত হতে এই মুহূর্তে চিনের ঋণ কমপক্ষে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ! যা চিনের সবচেয়ে বড় রিয়েল এস্টেট সঙ্কট হতে পারে এবং যেহেতু চিনের স্থাবর সম্পত্তি নিয়মানুযায়ী বড় অংশের মানুষ মোটা টাকার বিনিময়ে বায়না করেন এবং তার প্রশস্ত পথ হিসেবে বেছে নেন সরকারী এবং বেসরকারী ব্যাঙ্কের ঋণ ; তাই এ মুহূর্তে যদি Evergrande গ্যারান্টি অবলিগেশানে হাতেহাত দিতে না পারে তবে চিনের ক্রেডিট ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য ভাবে সঙ্কুচিত করবে। এরমধ্যে অনেক রিয়েল এস্টেট সংস্হা মার্কিন দেশীয় ডলারের বন্ড বাজারে ছেড়েছে। এ ঘটনা বিশেষ করে হংকংয়ে ঘটেছে, ফলে, বহু বন্ডের মূল্য বিনিয়োগ অর্থের নীচে নেমে আসে যা ও দেশের গভীর চিন্তার কারণ। চিনের non real estate চিনা ডলারের বন্ড বছরে ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও ২০১৯ এর পর থেকেই অফসোর বন্ড মুখপুড়িয়ে ৬ শতাংশে নেমেছে। চিনে যে মুহূর্তে আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয় তখনই ওরা সীমান্ত সমস্যা বা সাইকোলজিক্যাল ওয়ার তৈরি করে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর ওপর আধিপত্য এবং ব্যবসায়িক একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার প্রবণতায় চিড় ধরায় না।

ভারতের সাথে এই ধরনের কূটনৈতিক কূটকচালি করে চিন বোধহয় তেমন কোনো সুবিধা করতে পারবে না ।কারণ ইতিমধ্যেই তাইওয়ান নিয়ে যে পরিমাণ জলঘোলা দক্ষিণ চিন সমুদ্রে হয়েছে তাতে সৈকতে বিভেদের সুনামি আছড়ে পরেছে। দক্ষিণ চিন সমুদ্রের ১৮০ কিলোমিটার দূরে তাইওয়ান এখন চিনের আগ্রাসনের অ্যাসিড টেস্টার। দশকের পর দশক ধরে তাইওয়ান চিনের ” এক দেশ দুই নিয়ম” নীতি প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই দেশই কিনা আজ প্রথমবারের জন্য নিজেদের ” রিপাবলিক অফ চায়না” বলেছে। কিন্তু যেই মুহূর্তে তাইওয়ান এই শব্দবন্ধে এলো তার পর মুহূর্তেই কিন্তু তারা আর রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য রাষ্ট্র থাকতে পারল না। সারা বিশ্বের মাত্র পনেরোটি দেশ তাইওয়ানকে রিপাবলিক অফ চায়না- র স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারত এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কোনও ভাবেই রাষ্ট্রপুঞ্জে সমর্থন দেয়নি।করোনা অতিমারী এবং চিনের ভ্যাকসিন কূটনীতি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলেছে। এর মধ্যেও চিনের একটার পর একটা বেচাল পদক্ষেপ তাদের আরোএক জরিমানা দিতে বাধ্য করল। AUKUS এর সুরক্ষা সন্ধিতে চিন আমন্ত্রণ পায়নি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি স্হিতি বজায় রাখতে যে চিনকে এড়িয়ে চলা হচ্ছে তা ভীষণ স্পষ্ট। ঠিক তখনই তাইওয়ানের বিদেশ মন্ত্রী জোসেফ উও একটু চিন দূরত্ব তৈরি করে বলেন তাইওয়ান এই সুরক্ষা চুক্তির সমর্থক। চিন যা করে চলেছে তাকে পররাষ্ট্রনীতির পরিভাষায় বলে ” Strategic ambiguity” এবং ” Future proofing necessity ” এর জন্য তারা সদাব্যস্ত। বিভিন্ন অনুন্নত রাষ্ট্র চিনের অর্থনৈতিক উপনিবেশ হলেও তাইওয়ান তাদের প্রথম লিটমাস টেস্ট যেখানে তারা তাদের আন্তর্জাতিক জোর সমীক্ষা সরাসরি করতে পারল। চিন যে কেমলমাত্র জমি দখলের জন্যই উৎসাহী তা প্রমানিত এবং ” common prosperity ” র ধারধারেনা তারা। আজকে তাইওয়ান বা অরুণাচলের সাথে পিসফুল রিইউনিফিকেশনের ছদ্মনামে তারা যে আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রীয় মার্জিতবোধের অবমাননা করছে এ বিষয়ে কোনো সংশয় থাকতে পারেনা। যথার্থ ভাবেই চিন এক অন্য কূটনীতি শুরু করেছিল যার নাম ছিল ” mask diplomacy ” — করোনা মোকাবিলার সরঞ্জামের দক্ষিণ এশিয়া বিদেশনীতি। চিন বাস্তবেই এক মুখোশনীতির পালে ভর করে চলছে। ASEAN দেশগুলোর কাছে অবিশ্বাসের মেঘ ঘন করে যে জোড়াতালি ” পাবলিক গুড” মুখোশ চিনের ছিল তা পুঁতি গন্ধময়।

( এই প্রবন্ধে লেখা বক্তব্য সম্পূর্ণ লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত। সম্পাদক এর জন্য দায়ী নন। )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *