Blood : এত রক্ত কেন – শিশুটির সেই প্রশ্ণ আজ তাড়িত জওয়ানদের মনও

৷৷ সুকর্ণ ঘটক৷৷ আগরতলা, ৪ ডিসেম্বর৷৷ একের পর এক রক্ত ঝরছে৷ প্রাণ বলি হচ্ছে সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে পরিচিত জওয়ানদের মধ্যে৷ কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয়, কিছুদিন পরপর বাহিনীর জওয়ানরাই একে অপরকে খুন করছেন৷ নিজেরাও আত্মঘাতী হচ্ছেন৷ এটি উদ্বেগের ও সুশৃঙ্খল বাহিনীর মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার পক্ষে সহায়ক হচ্ছে৷ রক্ত আর রক্ত৷ বিসর্জন নাটকে সেই ছোট্ট শিশুটির কাতর প্রশ্ণ – এত রক্ত কেন এত রক্ত কেন৷


আজ আবারও ঝরল প্রাণ৷ সন্ত্রাসে নয়, অধস্তনের বিকৃত মানসিকতার বলি হলেন দুইজন টিএসআর জওয়ান৷ তাই, এখন অন্তত ভাবতেই হবে, সমস্যা কতটা গভীরে৷ শুধু মাত্র ছুটির আবেদন মঞ্জুর না হওয়ায় বন্দুকের গুলিতে ঝাজরা করতে হবে, মানবিকতা যে আজ ভূলুন্ঠিত, তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই৷ সাথে, ওই ঘটনার পেছনে দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা রাগের বহিঃপ্রকাশ হতেও পারে, এই ভাবনার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলেই মনে করি৷ দুইটি প্রাণের নির্মম পরিনতি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ তাই, মরচে ধরা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানোর তাগিদ অনুভব হচ্ছে৷ অবশ্য এই তাগিদ নতুন নয়৷ কিন্ত, পিঠ এখন দেওয়ালে গিয়ে ঠেকেছে৷ তাই এখন নতুন সূযর্োদয় হোক, জাতি এটাই চাইছে৷


আজ সুর্যোদয়ের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই টিএসআরের দুই জওয়ানকে গুলিতে ঝাজরা করে দিলেন অধস্তন এক কর্মী৷ তাঁদের রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন ওই ঘাতক জওয়ান৷ কিন্ত, তাঁকে পুলিশ গাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর হাবেভাবে কোথাও বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নজরে আসেনি৷ বরং তাঁর আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে৷ পুলিশ কর্তা আগামীকাল টিএসআরের সমস্ত কমান্ড্যান্টদের সাথে ভার্চুয়ালি আজকের ঘটনা এবং বাহিনীর সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন৷ সময়ের চাহিদায় ওই বৈঠকের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে৷ কিন্ত, সমস্যার মূলে পৌঁছাতে পারবেন তো, সেই প্রশ্ণ আজ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হচ্ছে৷


টিএসআর বাহিনীতে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়৷ ইতিপূর্বে, বাহিনীর বহু জওয়ান সার্ভিস রাইফেল থেকে গুলি ছুড়ে আত্মহত্যা করেছেন৷ সামান্য বাকবিতন্ডা থেকে সহকর্মীকে গুলিতে ঝাজরা করে দিয়েছেন৷ সমস্ত বাহিনীতেই এধরনের অস্বাভাবিক ঘটনার হাজারো উদাহরণ বাহিনীকে কলঙ্কিত করেছে৷ কিন্ত, প্রত্যেক ক্ষেত্রে ঘটনার পর বিভাগীয় তদন্তের নামে ফাইল হিমঘরে পাঠানোর তোড়জোড় হয়ে থাকে৷ টিএসআর বাহিনীও তার ব্যতিক্রমী ভূমিকার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি৷


ত্রিপুরায় উগ্রপন্থার সাথে লড়াই করার জন্য ১৯৮৪ সালে টিএসআর প্রথম ব্যাটেলিয়ানের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল৷ বর্তমানে টিএসআরের ১২টি ব্যাটেলিয়ান রয়েছে৷ তার মধ্যে ৯টি আইআর ব্যাটেলিয়ান৷ ত্রিপুরা যখন এনএলএফটি, এটিটিএফ-র হায়নাদের হিংস্রতায় কাবু ছিল, তখন টিএসআর জওয়ানদের অদম্য সাহস ও বলিদানে আমরা শান্তির রাজ্য উপহার হিসেবে পেয়েছি৷ উগ্রপন্থাকে ত্রিপুরা থেকে সমূলে উৎখাতে টিএসআর বাহিনীর অবদানকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই৷ বাহিনীর জওয়ানদের আত্মবলিদান নতুন ত্রিপুরা গঠনে অসামান্য ভূমিকা নিয়েছে, তাঁকে রাজ্যবাসী শ্রদ্ধায় স্মরণ করছেন প্রতিনিয়ত৷


কিন্ত, আজ ত্রিপুরা শান্ত হলেও, টিএসআর বাহিনীতে নিশব্দ ঝড় বয়ে চলেছে৷ সম কাজে সম বেতন শুধুই কাগজে সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ উঠেছে৷ সমালোচকদের মতে, রাজ্য আজ উগ্রপন্থা থেকে মুক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্ত টিএসআর বাহিনীর একাংশের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে৷ নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত বীর জওয়ানদের আদালির কাজ করতে হচ্ছে৷ কখনো উর্ধতন আধিকারিকের খাই-ফরমাস মিটাতে গিয়ে আত্মসম্মানে আঘাত লাগছে৷ তাহলে, অপরাধী কে? ঘুণে ধরা ব্যবস্থাকে, নাকি অবহেলিত জওয়ানদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত, জাতি জানতে চাইছে৷


আজ দুই টিএসআর জওয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যু প্রমাণ করেছে, মানুষ কতটা অমানবিক, সাথে সমগ্র ব্যবস্থা কতটা পঙ্গু হয়ে গেছে৷ জাতির নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রত্যেক জওয়ানকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা উচিত৷ সেক্ষেত্রে তাঁর শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার দিকেও খেয়াল রাখা ততটাই জরুরি বলেই মনে হচ্ছে৷ টিএসআর বাহিনীতে কর্মী স্বল্পতায় কাজের চাপ অনেক ক্ষেত্রেই বেড়ে যায়৷ অন্যদিকে, এমনও ব্যাটেলিয়ান রয়েছে তাঁদের উপর চাপ অনেকটাই কম রয়েছে৷ আজ রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক জানিয়েছেন, জওয়ান ছুটি চাইলে তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আবেদন মঞ্জুর করাই বাঞ্চনীয়৷ আগামী দিনে বিষয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই বিবেচনা করা হবে৷ কিন্ত, এখানে এই আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে, দাবি আদায়ে বন্দুকের নল মাধ্যম হতে পারে৷
কর্মক্ষেত্রে অবসাদ থেকে মুক্তি ভীষণ উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে৷ সেক্ষেত্রে টিএসআর বাহিনীতে প্রত্যেকের মানসিক সুস্থতার দিকে বাড়তি নজর দেওয়া প্রয়োজন বলেই মনে হচ্ছে৷ এ-জন্য প্রত্যেক ব্যাটেলিয়ানে সময়ের অন্তরালে কাউন্সেলিং-র যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই৷ সাথে, কাজের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন বলেই মনে হচ্ছে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *