BRAKING NEWS

কোথায় নেই রাম

রবীন্দ্র কিশোর সিনহা

নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি এখন বলেছেন ভগবান রাম ভারতীয় নন, তিনি নেপালি ছিলেন। তিনি এটাও বলছেন যে, আসল অযোধ্যা ভারতে নয়, নেপালের বীরগঞ্জে রয়েছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী ওলিজিকে এটা কে বোঝাবে, ভগবান রাম তো সমগ্র মানবজাতির। সর্বত্র ভগবান রাম বিরাজমান। হ্যাঁ, ভগবান রাম নেপালেও, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, রুমালিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং কোরিয়াতেও বিরাজমান। নেপাল এবং নেপালের জনগণেরও ভগবান রামের উপর সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। ভগবান রাম সকলের আরাধ্যা। বুঝতেই পারছি না ওলিজি কী কারণে ভগবান রামকে শুধুমাত্র একটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন। ওলিজির এই ধরনের অযৌক্তিক মন্তব্য নিয়ে তো কিছু বলা যায় না। তবে, আমরা সর্বদা এটাই বিশ্বাস করি, রাজকুমার রামকে সীতার মতো স্ত্রী দিয়েছি আমরা। তবে, আমরা মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান রামকেও দিয়েছি। আমরা রামকে অযোধ্যা থেকে দিয়েছি, ভারত থেকে নয়।

ওলিজি যা বলেছেন, তা নতুন কিছু নয়। আদিবাসী থারু সমাজে প্রাচীন বিশ্বাস রয়েছে যে, ভগবান রামের জন্মস্থান পশ্চিম চম্পারণ সংলগ্ন গন্ডক অঞ্চলের ভিখনা থাডিতে। লব-কুশের লালনপালন স্থল বাল্মীকি আশ্রমও সেখানেই। এখন তিনি অসংখ্য দাবি করলেও, এটা তো সত্যি বিশ্বের অনেক দেশ ভগবান রামকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে। আসলে রাম সকলের আরাধ্যা। কোরিয়ার সঙ্গে অযোধ্যার ২০০ বছরের পুরনো সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। সেখানেও একটি অযোধ্যা রয়েছে, যা আয়ুতা নামে পরিচিত। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে রামকথা প্রচলিত। ভারতীয়দের আবেগের অনুরাগ থাকা স্বাভাবিক। ইসলামিক দেশ ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতে রামায়ণের গভীর ছাপ রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের নামকরণ হয়েছিল সুমিত্রার নামে। ইন্দোনেশিয়ার জাভা শহরের একটি নদীর নাম সরায়ু। মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার রামলীলা সম্পর্কে প্রায়শই লেখালেখি হয়। যখন সেখানকার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, তখন বিজু পট্টনায়েক (ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের বাবা) তাঁকে নিজ বিমানে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সুকর্ণর মেয়ের যখন জন্ম হয়েছিল, তখন শ্রী পট্টনায়েক মেয়ের নাম রেখেছিলেন সুকর্ণপুত্রী মেঘাবতী। এই নাম সেখানে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং পিতার মতো তিনিও ক্ষমতা প্রধান নির্বাচিত হন।

নিজের ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি

৮০-র দশকে ৫০ জন ভারতীয় প্রতিনিধি দলকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিলাম আমি। প্রয়াত বালেশ্বর আগরওয়াল ওই প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন এবং উপ-নেতা। আমরা যখন জাভার সবথেকে বড় এবং প্রাচীন নবম শতাব্দীর বোরোবুদুর বৌদ্ধ মন্দির দর্শন করে ফিরছিলাম, তখন মন্দিরের সিঁড়িতে একজন বৃদ্ধ মৌলবি বাটি নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন। আমার কাছে ইন্দোনেশিয়ার এক হাজার টাকার নোট ছিল, যা ভারতীয় মুদ্রায় একশো টাকা। আমি সেই টাকা বাটিতে দিয়ে দিই। মৌলানা প্রথমে নোটটি ভালোভাবে দেখেন, এরপর আমার দিকে তাঁকিয়ে বলেন, ‘ইন্ডিয়ান?’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ’। তিনি নোট ফেলে দিয়ে বলেন, ‘তোমরা চোর’। এরপর ইন্দোনেশিয়া ভাষায় কিছু বলতে থাকে। আমি তখন গাইডকে জিজ্ঞাসা করি, এই মৌলানা আমাকে চোর বলল কেন? তখন গাইড বলেন, মৌলানা বলছে আপনারা অনেক বড় চোর। আপনারা ইন্দোনেশিয়া থেকে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, হনুমান, কর্ণকে চুরি করেছেন। গাইড জানান, সমগ্র ইন্দোনেশিয়ার জনগণ এমনটা মনে করেন। স্বল্প শিক্ষিতদের এমনই চিন্তাভাবনা। এত তো একটি ইসলামিক দেশের অবস্থা।

ওলি হয়তো জানেন, এখনও থাইল্যান্ডে রাজাকে রাম বলেই সম্বোধন করা হয়। রাজার নামের সঙ্গে রাম সম্বোধন করা অনিবার্য। রাজপরিবার অযোধ্যা নামক শহরে থাকে। ওই স্থান ব্যাঙ্ককের কাছেই। এটা কী কম অবাক হওয়ার বিষয় যে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও থাইল্যান্ডের মানুষজন নিজেদের রাজাকে রামের বংশধর হিসেবে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করেন। এজন্যই থাইল্যান্ডে এখনও রাম রাজ্য বিদ্যমান। হিন্দু প্রতীক ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বুঝতে ও জানতে হলে থাইল্যান্ডের মতো কোনও দেশই নেই। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই দেশে হিন্দু দেবী-দেবতা ও প্রতীক সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যাবে।থাইল্যান্ডের ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তা সত্ত্বেও সেখানকার রাষ্ট্রীয় চিহ্ন গরুড়। হিন্দু ধর্মের পুরাণ অনুযায়ী গরুড়কে বিষ্ণুর বাহন মনে করা হয়। গরুড় আসলে অর্ধ পাখি এবং অর্ধ পুরুষ। গরুড়ের শরীর মানুষের মতো, মুখ পাখির মতো। ডানাও রয়েছে। একইভাবে ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয় বিমান সংস্থার নাম গরুড় এয়ারলাইন্স।

ওলিজি ভারতের সর্বত্রই ভগবান রাম বিরাজমান। রামকে আপনি নেপালের মনে করুন তাতে ভারতের কিছু আসে যায় না। সমগ্র ভারত রামকে আরাধ্যা এবং পূজনীয় মনে করে। মহান সমাজবাদী নেতা ডাঃ রাম মনোহর লোহিয়া বলতেন, ভারতের তিনটি বৃহত্তম পৌরাণিক নাম-রাম, কৃষ্ণ এবং শিব। তাঁর কাজ সম্পর্কে প্রায় সকলেই অবগত। তাঁর কাজ এবং চিন্তাভাবনা সম্পর্কে প্রায় সবই সকলের জানা। একবার ভেবে দেখুন, ভারতীয় জনগন দিনে কতবার প্রভু রামের বন্দনা করেন। ভারত তো রামের নাম জপ করবেই। ভারতীয় মুসলিমরাও রামকে শ্রদ্ধা করেন। শ্রীরাম ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক। কবি ইকবাল ১৯০৮ সালে শ্রীরামের গৌরবে একটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন। তিনি ভগবান রামকে রাম-ই-হিন্দ বলতেন। তিনি কবিতায় লিখেছিলেন, রামের অস্তিত্বে গর্বিত হিন্দুস্থান। অর্থাৎ শ্রীরাম ভারতে জন্ম নেওয়ায় ভারতেরই গর্ব এবং সমস্ত জ্ঞানী মানুষজন তাঁকে ভারতের আধ্যাত্মিক গুরু মনে করেন। গান্ধীজি ভারতে রাজরাজ্য প্রতিষ্ঠা দেখতে চেয়েছিলেন। ওলিজি আপনিও নেপালকে রামরাজ্যে পরিণত করুন। ওলিজি সম্ভবত জানেন, রামরাজ্য ন্যায়বিচার ও সাম্যের মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয়।

জাতির জনক গান্ধীজি এমন এক রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা পবিত্র ও সত্যনিষ্ঠার উপর ভিত্তিশীল। রাম তো প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের ঈশ্বর। যদি কেউ রামকে নেপালের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন তাতে কী আসে-যায়। ওলিজি মাকর্সবাদী হওয়া সত্বেও রামের কাজ করছেন, বিশ্বাস করুন। পবিত্র শ্রাবণ মাসে তিনি নিশ্চয়ই পশুপতিনাথের কাছ থেকে রামভক্তির প্রেরণা পেয়েছেন। ভারত তো রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ওলির কী একই ইচ্ছা? তিনি কী রামের নামে ভারত-নেপালকে বিভক্ত করতে চাইছেন? রামের ব্যক্তিত্ব বুখতে হবে তাঁকে। এক একটি পাথর জুড়ে ভারত ও লঙ্কার মধ্যে সেতু তৈরি করা হয়েছে। এই উপক্রমে তাঁকে সবাই সাহায্য করেছেন। তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন এবং অন্যকে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের ঈশ্বর নন,  বরং  ভারতীয় ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং এই ঐতিহ্যকে ভাগ করা সম্ভব নয়। রামের নাম ভারতের বাইরে বসবাসরত কোটি কোটি ভারতীয়কে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে। বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক চেতনার মহান দূত হলেন রাম। মায়ানমারেও রাম আছেন। সেখানকার পোপা পর্বত ওষুধের জন্য বিখ্যাত। মনে করা হয় লক্ষ্মণের চিকিৎসার জন্য পোপা পর্বতের একটি অংশ উপড়ে এনেছিলেন হনুমান। তাঁরা পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা পর্যটকদের দেখিয়ে বলেন, ওই অংশটি উপড়ে লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিলেন হনুমান। ওলিজি আপনি রামকে নেপালের ভাবতে থাকুন। রাম তো সমগ্র বিশ্বের। নিজ দেশবাসীকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন, প্রতিটি নেপালির আরাধ্য হলেন রাম।

(লেখক প্রবীণ সম্পাদককলামিস্ট এবং প্রাক্তন সাংসদ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *