BRAKING NEWS

ফের পিছিয়েছে প্রত্যাবর্তন, নিরাপত্তা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য ত্রিপুরায় স্থায়ী বসবাসে ইচ্ছুক মিজোরামের শরণার্থীরা

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৯ মে৷৷ দুই দশকের বিড়ম্বনার অবসান নিয়ে যতটা চিন্তিত কেন্দ্র ও ত্রিপুরা সরকার, রিয়াং শরণার্থীদের তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হচ্ছে না৷ ত্রিপুরার উত্তর জেলার কাঞ্চনপুর মহকুমায় নাইসিংপাড়ায় শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত ব্রু শরণার্থীদের মিজোরামে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া আবারও পিছিয়ে গেছে৷ তাঁদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার সময়সীমা সেপ্ঢেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে৷ অবশ্য নিরাপত্তা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রশ্ণে তাঁরা ত্রিপুরাতেই স্থায়ীভাবে থাকতে চাইছেন৷ তাই ত্রিপুরায় স্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেওয়ার দাবি তাঁদের দীর্ঘদিনের৷


১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে মিজোরামের মামিথ জেলার দুয়াপায় মিজো বনরক্ষীকে নৃশংসভাবে খুন করেন ব্রু উগ্রবাদীরা৷ তার পর থেকেই মিজোরামে রিয়াংদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়েছিল৷ বহু ব্রু গ্রাম মিজোদের হিংসার আগুনে ছাই হয়ে গিয়েছিল৷ তখন আত্মরক্ষায় ভিটেমাটি ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মিজোরামের ব্রু জনগোষ্ঠী ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতে শুরু করেন৷ মিজোরামের মামিথ, কোলাশিব এবং লুংলেই জেলা থেকে হাজার হাজার শরণার্থী ত্রিপুরার কাঞ্চনপুর এবং পানিসাগরে অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নেন৷ মানবিকতার খাতিরে ত্রিপুরায় মিজোরামের ব্রু জাতিগোষ্ঠীর অসহায় পরিবারগুলিকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করে তদানীন্তন রাজ্য সরকার৷


তার পর থেকে ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়ে জীবন শুরু হয় ব্রু’দের৷ তবে সময়ের সাথে পরিস্থিতিরও বদল হয়৷ ত্রিপুরায় আশ্রিত ব্রু শরণার্থীদের মিজোরামে প্রত্যাবর্তনে দুই দশকে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ কিন্তু প্রতিবারই নোংরা রাজনীতি এবং ব্যক্তিস্বার্থের কারণে ভেস্তে গেছে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া৷ ব্রু শরণার্থীদের সংগঠন মিজোরাম ব্রু ডিসপ্লেসড পিপলস ফোরাম (এমবিডিপিএফ) প্রত্যাবর্তনে প্রতিবার নতুন শর্ত জুড়ে দিয়ে সমস্ত প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দিয়েছে৷


এমবিডিপিএফ-এর দাবি, মিজোরামে স্থায়ী বসবাস, পাঁচ হেক্টর জমি, ৫০০ পরিবার পিছু একটি ক্লাস্টার গ্রাম এবং চার লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ-সহ ভোটার তালিকায় নাম সংশোধন ও সামাজিক মর্যাদা দিলে তাঁরা মিজোরামে ফিরে যাবেন৷ ইউপিএ জমানায় ত্রিপুরায় আশ্রিত ব্রু শরণার্থীদের মিজোরামে প্রত্যাবর্তন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার, ব্রু শরণাথী সংগঠন, ত্রিপুরা সরকার ও মিজোরাম সরকারের আলোচনা শুরু হয়৷ কিন্তু কোনও আলোচনাই ফলপ্রসূ হয়নি৷ কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর ফের ব্রু শরণার্থীদের মিজোরামে প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া নতুনভাবে শুরু হয়৷ দীর্ঘ আলোচনা, দাবি-আপত্তি নিয়ে চর্চা হওয়ার পর স্থির হয় ত্রিপুরায় আশ্রিত ব্রু শরণার্থীদের দুই বছরের জন্য প্রতি মাসে প্রতি পরিবার ৫,০০০ টাকা, ঘর বানানোর জন্য এককালীন দেড় লক্ষ টাকা এবং দুই বছরের জন্য বিনামূল্যে প্রতি পরিবারকে রেশন দেওয়া হবে৷ এই শর্তে সম্মত হয় ব্রু শরণার্থী সংগঠন৷ সেই মোতাবেক চুক্তি হয়, ২০১৮ সালের সেপ্ঢেম্বর থেকে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হবে৷ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শাখার বিশেষ সচিব রিনা মিত্র, ত্রিপুরা সরকারের মুখ্যসচিব সঞ্জীব রঞ্জন, মিজোরাম সরকারের মুখ্যসচিব লালনুনমাবিয়া এবং এমবিডিপিএফ-এর সভাপতি এ সবিবুঙ্গা৷ ব্রু শরণার্থীদের মিজোরামে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও ত্রিপুরা সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অবশেষে সফলতার দিকে পা বাড়িয়েছে বলে মনে হয়েছিল৷


পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ত্রিপুরায় কাঞ্চনপুর এবং পানিসাগরে মিজোরামের ব্রু জনগোষ্ঠীর ৫,৪০৭ পরিবারের ৩২,৮৭৬ জন অস্থায়ী শিবিরে আশ্রিত রয়েছেন৷ চুক্তি অনুযায়ী স্থির হয়েছিল, এই সব ব্রু শরণার্থীদের মধ্যে মিজোরামের মামিথ জেলায় ৪৮টি গ্রামের ৪১৯৯ পরিবার, কোলাশিব জেলায় ১০টি গ্রামের ৮২৪ পরিবার এবং লুংলেই জেলায় ৪টি গ্রামে ৩৮৪ পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়া হবে৷
সেই মোতাবেক ২০১৮ সালের ১৯ সেপেম্বর ১৭৭ পরিবার এবং ২৬ সেপেম্বর ৩২ পরিবার ত্রিপুরায় শরণার্থী শিবির থেকে মিজোরামে ফিরে যান৷ ৩০ সেপ্ঢেম্বর আরও একটি পরিবার স্বভূমে ফিরে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু তার পরই ফের জটিলতা দেখা দেয়৷ থমকে যায় প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া৷ ব্রু শরণার্থী সংগঠন নিজেদের পূর্বের দাবিতে ফিরে যান এবং ওই দাবিগুলি পূরণ না হলে তাঁরা মিজোরামে ফিরবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন৷ এর পর একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার সময়সীমা৷
প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় যুক্ত আধিকারিক দেবেন্দ্র রিয়াং জানিয়েছেন, গত সেপ্ঢেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত দুই দফায় সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে৷ তিনি জানান, প্রথমে তাঁদের প্রত্যাবর্তনে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানো হয়৷ তাতেও কোনও সুরাহা না হওয়ায় ফের বৃদ্ধি করা হয় সময়সীমা৷ স্থির হয়, ৩১ মার্চের মধ্যে তাঁদের মিজোরামে ফিরে যেতেই হবে৷ নইলে বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁদের বিনামূল্যের রেশন৷ কিন্তু এক্ষেত্রেই ব্যর্থতা হাতে আসে কেন্দ্রীয় সরকারের৷ প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় কোনও নতুন শর্ত মেনে নেওয়া হবে না, সাফ জানানো হলে বেঁকে বসেন ব্রু শরণার্থীরা৷ ফলে, এখন ৩০ সেপ্ঢেম্বর পর্যন্ত তাঁদের মিজোরামে ফিরে যেতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক৷ আবারও রেশন বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দিয়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক৷ কিন্তু তাতে সাফল্য আসবে বলে মনে হচ্ছে না৷


এমবিডিপিএফ-এর সভাপতির কথায়, মিজোরামে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবর্তনের কোনও সুযোগ নেই৷ তার বদলে ত্রিপুরাতেই তাঁদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হোক৷ তাঁর কথায় মনে হয়েছে, মিজোরামের তুলনায় ত্রিপুরায় বসবাস অনেক নিরাপদ৷ তাই তাঁরা মিজোরামে ফিরে যেতে চাইছেন না৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *