ঢাকা, ৯ মার্চ (হি.স.): সাম্প্রদায়িক শক্তি সরকারের ভিতরে ও বাইরে অবস্থান করে বাংলাদেশের শান্তিকে আবারও অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করছে। বহুভাষী সংবাদ সংস্থা হিন্দুস্থান সমাচার-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমনই অভিমত পোষণ করলেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। একাত্তরে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হয়, যার চার মূল নীতি ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাতিল করে দেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ইসলামি খোলসে মুড়ে দেন। সংবিধানের সূচনা করেন বিসমিল্লাহ দিয়ে। এরপর ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান ইসলামিকরণে আরও একধাপ এগিয়ে যান, ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। এর মাধ্যমে অমুসলমান নাগরিকরা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হন। এরই প্রেক্ষাপটে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ও আদিবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
ঐক্য পরিষদের তিন সভাপতি হলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্ত বীরউত্তম, খ্রিস্টান নেতা হিউবার্ট গোমেজ ও আদিবাসী নেতা ঊষাতন তালুকদার। সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. রানা দাশগুপ্ত, যিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কৌঁশুলি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি, রাজনীতি ও সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে হিন্দুস্থান সমাচার শুক্রবার মুখোমুখি হয় রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে। বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে হিন্দুস্থান সমাচার-এর পক্ষ থেকে মোট সাতটি প্রশ্ন করা হয় রানা দাশগুপ্তকে। সর্বপ্রথম প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে বর্তমানে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কি রকম ? উত্তরে
রানা দাশগুপ্ত জানান, গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আগের তুলনায় বেশ খানিকটা সহনশীল। এই সহনশীল অবস্থার মধ্যেও ঢাকার মীরপুরে কেন্দ্রীয় মন্দিরের কালীবিগ্রহ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে ভাঙচুর করা হয়েছে। ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের চরবানিরী গ্রামের পৈতৃক বাড়ি রাতের অন্ধকারে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে গত ২ মার্চ। এমন সংবাদ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আবারও আসতে শুরু করেছে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতীরা সরকারের ভিতরে ও বাইরে অবস্থান করে গত কয়েক মাস ঘাপটি মেরে থেকে আবারও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, একাদশ জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ঐক্য পরিষদ কি সন্তুষ্ট। রাজনৈতিক দলগুলির মনোনয়ন কি যথাযথ ছিল ? প্রশ্নের জবাবে রানা দাশগুপ্ত বলেন, দেশের বর্তমান জনসংখ্যার মোট এক অষ্টমাংশ হচ্ছে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ২০১১ সালের বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনগণনার পরিসংখ্যানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা সর্বমোট জনসংখ্যার ৯.২ শতাংশ। বছরখানেক আগে ব্যুরো এক রিপোর্টে জানিয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে হিন্দু জনসংখ্যা ২% বেড়েছে। সে হিসেবে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সংরক্ষিত মহিলা আসন-সহ জাতীয় সংসদের মোট ৩৫০টি আসনে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব হওয়ার কথা ছিল ৪৩ থেকে ৪৫। সে স্থলে বর্তমান সংসদে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব ২১। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৫৪ সালে পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম আইন পরিষদ নির্বাচনে মোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব ছিল ৭২। সেই সময়কার পূর্ববঙ্গে আতাউর রহমান খান ও আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভায় ১০ জনের মধ্যে ৪ জন ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভোটারদের মধ্যেকার এ ধর্মীয় বিভাজনমূলক প্রক্রিয়া থেকে উত্তরণের জন্যে তৎকালীন বিরোধী দল কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের (একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি হত্যা করে) নেতৃত্বে পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে যুক্ত নির্বাচনের দাবি উত্থাপিত হয় অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বাতাবরণ গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে।
১৯৬৫ সালে হোসেন শহিদ সোহ্রাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান আইন পরিষদে যুক্ত নির্বাচন বিল পাশ হয়। এই যুক্ত নির্বাচনী প্রথায় পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত আওয়ামি লিগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় অবশেষে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫-র ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সংবিধান থেকে রাষ্ট্রীয় অন্যতম মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়ার পর পুনরায় পাকিস্তানি ধারা ফিরে এলে সংসদে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব নেমে আসে ২-এ। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে গত ৪৭ বছরে বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনেই সবচেয়ে বেশী ২১ জন সংখ্যালঘু সংসদে এসেছেন। এতে সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ রয়েছে। তবে আমরা মনে করি, সংসদে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের সংসদে ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল সকল সংস্থায় আসন সংরক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এ দাবিটি উত্থাপিত হয়েছে। তবে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামি লিগ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলির মনোনয়ন আগের তুলনায় ভালো ছিল, তবে একেবারেই যথেষ্ট ছিল না।
রানা দাশগুপ্তকে তৃতীয় প্রশ্ন করা হয়, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা কি রকম অংশগ্রহণ করছেন ? উত্তরে তিনি জানান, সংখ্যালঘুদের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রবণতা আগের থেকে অনেক বেড়েছে। কিন্তু, রাজনৈতিক দলগুলি থেকে প্রার্থী মনোনয়ন অনেক কম। ৪৬৫ টি উপজেলার মধ্যে সরকারি দল আওয়ামি লিগ ২০ জনের মতো প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচন বর্জন করছে। স্বতন্ত্রভাবে সংখ্যালঘুরা নির্বাচনী মাঠে অংশ নিতে ভয় পায় নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় ও কালো অর্থনীতির দাপটে- এটিই সত্য। চতুর্থ প্রশ্ন করা হয়- শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন হওয়ার পর কতজন হিন্দু সম্পত্তি ফেরত পেয়েছেন ? অগ্রগতি কতটুকু ? উত্তরে রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, ২০০১ সালের অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রণীত হয় আওয়ামি লিগ সরকারের সময়। কিন্তু ওই বছরের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর আইনটি অকার্যকর করে রাখা হয়। ২০০৭ সালে তদারকি সরকার ক্ষমতায় আসে, তাদের দু’বছর মেয়াদেও অকার্যকর থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামি লিগ সরকার ক্ষমতায় এলে আমাদের দাবি অনুযায়ী ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ৬টি সংশোধনী এনে একে বাস্তবানুগ করা হয়। এরই মধ্যে ৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও এর অগ্রগতি মোটেও সুখকর নয়। ‘ক’তপশীলভুক্ত সম্পত্তি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে মোট ১,১৬,০০০ আবেদনের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫ হাজারের মতো অর্থাৎ মোট আবেদনের ১২% থেকে ১৫%। আবেদন নিষ্পত্তির এ ধারা অব্যাহত থাকলে তা নিষ্পত্তি হতে ভুক্তভোগীদের আরও তিন দশক অপেক্ষা করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনের মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক মানসিকতাদোষে দুষ্ট আমলারা এ আইন বাস্তবায়নে ও ভুক্তভোগীদের বরাবরে সম্পত্তি প্রত্যর্পণে বাধার প্রাচীর সৃষ্টি করে চলেছে। এ চক্রান্ত এখনো অব্যাহত আছে, যদিও সরকারি দলের সাম্প্রতিক নির্বাচনী ইশ্তেহারে ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সামনে রেখে’ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘অর্পিত সম্পত্তি সংশোধনী আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।’
হি. স ঃ কেউ কেউ বলছেন, ঐক্য পরিষদ আওয়ামি লিগের অঙ্গ সংগঠনের মতো কাজ করছে, এটা কি ঠিক ?
রানা দাশগুপ্ত ঃ ১৯৭২ সালের গণতান্ত্রিক সংবিধান থেকে সামরিক ফরমানবলে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিলোপ এবং একই ধারায় ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসেবে সংযোজনের পর মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্ত বীরউত্তম, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সুধাংশুশেখর হালদার, বৌদ্ধ নেতা শ্রীমৎ বোধিপাল মহাথেরো, খ্রিস্টান নেতা টি রোজারিও প্রমুখের নেতৃত্বে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, ইসলামিকরণের এই চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রধান দুই দল আওয়ামি লিগ ও বিএনপির ‘প্রায় নিষ্ক্রিয়তা’ আমাদের হতাশ করেছিল, স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যালঘুদের সামনে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম গড়ে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। পরে তিন সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জনেরা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া জনসংহতি সমিতি ঐক্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয়। এ সংগঠন ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র নয় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই’-এ শ্লোগানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বৈষম্যবিরোধী মানবাধিকারের আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। একদিকে সকল প্রকার ধর্মীয় বৈষম্যের অবসান, অন্যদিকে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ও অস্তিÍত্ব রক্ষা এবং জীবন জীবিকার সকল পর্যায়ে তাদের সম-অধিকার ও সম-মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষে নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও এ সংগঠন কাজ করে চলেছে। দুঃজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র নীতি ও সংখ্যালঘু স্বার্থের কট্টরবিরোধী। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নীতির প্রতি বেশ খানিকটা আন্তরিক বাম রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক মাঠে ক্রমশঃ গুরুত্ব হারাচ্ছে, হারিয়েছে। এমনতরো পরিস্থিতিতে ভংগুর গণতান্ত্রিক পরিবেশে সীমিত হলেও সংখ্যালঘুদের অধিকতর বিপন্নতার হাত থেকে রক্ষায় অনেক সময় কৌশলগতভাবে রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রনীতিতে আপেক্ষিকভাবে বিশ^াসীদের উপর অব্যাহত চাপ রাখতে হয় যাতে তারাও অন্তত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাছে হারিয়ে না যায়। যদিও আমরা জানি, এহেন বিশ^াসীদের মধ্যেকার বড় অংশে ছলনার আশ্রয় নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে। যারা ঐক্য পরিষদের মানবাধিকার আন্দোলনের কৌশলে ভয় পায় বা এ আন্দোলনকে তাদের সংকীর্ণ স্বার্থের বিরোধী মনে করে বা তাদের আমলের সংকীর্ণ রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় মনে করে। তারা-ই এ সংগঠনকে আওয়ামি লিগের অঙ্গসংগঠনের লেবাস পরিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলে প্রকারান্তরে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে ঐক্য পরিষদ যেমনিভাবে কোন রাজনৈতিক দল নয়, তেমনিভাবে কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনও নয়। ঐক্য পরিষদ তার স্বাধীন সত্তা ও অস্তিত্বে বিশ^াস করে। যা কিছু করছে তার সবটাই সংখ্যালঘুদের স্বার্থে।
পঞ্চম প্রশ্ন- সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও বাংলাদেশ কি ধর্মনিরপেক্ষতার পথে চলছে ? রানা দাশগুপ্ত বলেন, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হলে সংবিধানের দিকে তাকাতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আছে, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবেও আছে; বাংলাদেশ আছে, পাকিস্তানও আছে। সংবিধানের এ হিপোক্র্যোটিক চরিত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং জনগণের বিশাল অংশের মননে মানসিকতায় কাজ করছে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রধর্ম ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নীতি সম্পর্কিত সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদের সাথে একেবারেই সাংঘর্ষিক। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে যতটুকু না চললে নয়। কারণ, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে দেখাতে হলে এ লেবাস নেয়া ছাড়া বিকল্প আর কি আছে ? বর্তমানে সরকারপ্রধান ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পক্ষে আন্তরিক থাকলেও সামগ্রিক রাজনৈতিক-সামাজিক দৃশ্যপট তাঁর আন্তরিকতায় এখনো পর্বতপ্রমাণ বাধা হয়ে আছে। না হলে, সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগনিষ্ঠতা থাকা সত্বেও ৭২-র বঙ্গবন্ধুর সংবিধানে ফিরে যেতে বঙ্গবন্ধুর দলের বাধা কোথায় ? সপ্তম তথা অন্তিম প্রশ্ন ছিল- ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পৃথক রাজনৈতিক দলের সম্ভাবনা কতটুকু ? উত্তরে রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, পাকিস্তানি আমলের সূচনায় অনেকটা সংখ্যালঘুদের দল কংগ্রেস ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় অব্যাহত থাকলেও মাত্র এক দশকের মধ্যে তা হারিয়ে যায়। আওয়ামি মুসলিম লিগ ‘আওয়ামি লিগ’এ রূপান্তরিত হলে কংগ্রেস রাজনৈতিক দল হিসেবে এতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষের কালেই তা ঘটে এবং এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারা অধিকতর বেগবান হয়, যাতে স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারা পাকিস্তানি আমলের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে তেমনভাবে ক্রিয়াশীল নয়। অনেকেই ভেবেছিলেন, ৭১-র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আবির্ভাব বাঙালির আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক আবসান ঘটিয়েছে, বস্তুত: তা সত্যি নয়। বরং দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়েছে। এমনতরো দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের জন্যে পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখা দরকার। যা-ই হোক, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা হিসেবে সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক দল গঠনের নিবরছিন্ন প্রয়াসও ৮০-র দশক থেকে কম হয় নি। প্রয়াত মেজর (অব.) অনুকুল দেব এ চিন্তা থেকে ‘হিন্দু লিগ’ গঠন করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা খুব বেশি দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয় নি। বছর খানেক আগে একই দিনে বাংলাদেশ মাইনোরিটি জনতা পার্টি ও বাংলাদেশ মাইনোরিটি পার্টি নামে দু’টি সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে দেখা গেলেও আত্মপ্রকাশের পরদিন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ মাইনোরিটি পার্টির আর সন্ধান পাওয়া যায় নি। অন্যদিকে দেখা যায় নির্বাচনের প্রাক্কালে স্বাধীনতাবিরোধী ফ্যাসীবাদী দল জামায়াতে ইসলামের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে বিএনপি থেকে প্রার্থী মনোনয়নে নিষ্কল চেষ্টা তদবির করেছে বাংলাদেশ মাইনোরিটি জনতা পার্টি। আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট নির্বাচনের প্রাক্কালে একবার দেখা গেলো রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ৩০-দলীয় জোটের সাথে আওয়ামি লিগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সাথে রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নিয়েছে, এর দু’একদিন পর পুস্পস্তবক হাতে নিয়ে এ দল বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের কাছে ধর্ণা দিয়েছে। এ থেকে সুস্পষ্ট, বাংলাদেশের বিরাজিত বাস্তবতায় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক দল করা হলেও তা স্থায়িত্ব পাচ্ছে না, আবার অন্যদিকে দলগুলোর নেতৃত্বের মধ্যে অস্থিরতা এবং লক্ষ্যের সংকট বিরাজ করছে। ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুরা এ সব দলের ধারে কাছেও ঘেঁষতে চাইছে না। এ সবের অর্থ এই নয় যে, ভবিষ্যতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পৃথক রাজনৈতিক দলের সম্ভাবনা দেখা যাবে না। তবে এর জন্যে রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা নয়, বাস্তবতা ও সংখ্যালঘুদের মনন-মানসিকতাকে বিবেচনায় আনতে হবে।