বিশাল ভবন একের পর এক নির্মানের মাধ্যমে এই প্রত্যন্ত রাজ্য ত্রিপুরা উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির মধ্যে বিশেষ স্থান নিতে পারে৷ কিংবা পুরস্কার জুটিয়া যাইতে পারে৷ বহির্রাজ্যের পর্য্যটকরা এরাজ্যের সড়ক, রাস্তাঘাটের সুবিন্যস্ত চিত্র দেখিয়া মুগ্দ না হইয়া পারিবেন না৷ সম্ভবত, গত দুই দশকে এই ছোট্ট রাজ্যের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের বাস্তব রূপায়ন চোখে পড়িবেই৷ চুরি চামারী চলিলেও উন্নয়ন চোখে পড়ার মতোই৷ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ত্রিপুরার পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনাও এই বাস্তবতারই অঙ্গ বলিলে বোধহয় ভুল বলা হইবে না৷ এই উন্নয়নের ছবি চোখে বিস্ময় আনিলেও এরাজ্যের মূল অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রকৃত চিত্র কতখানি তাহা নিয়া প্রশ্ণ থাকিয়া যাইতেছে৷ অনেকেই বলিয়া থাকেন এরাজ্যে ভিক্ষুক নাই৷ অন্তত পঁচিশ ত্রিশ বছর আগের চিত্রটা ছিল অন্যরকম৷ বাড়ী বাড়ী ভিক্ষাপাত্র হাতে লোকের দেখা মিলিত৷ আজ এই সংখ্যাটা একেবারেই শূন্যের কোটায়৷ ত্রিপুরায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের গতি কতখানি তাহাই আসল কথা৷ ভিক্ষুক নাই বলিয়া গরীব অংশের মানুষ নাই? মানুষ আর্থিক সংকটে কষ্ট পাইতেছে এমন লোকের সংখ্যা তো ভুরি ভুরি৷ এরাজ্যে কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ সৃষ্টি হয় নাই৷ শিল্প তো তলাইয়াই গিয়াছে৷ অথচ প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া রাজ্যে আন্তর্জাতিক শিল্প ও বাণিজ্য মেলা করা হয়৷
এই মেলার কল্যাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত উদ্যোক্তাদের পকেট ভারী হয়৷ এক বছর এই শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় বত্তৃণতাবাজী ছাড়া কি সাফল্য পাওয়া গিয়াছে? এরাজ্যে শিল্প তো শুকাইয়া গিয়াছে৷ অভিযোগ আছে, রাজ্যে শিল্প স্থাপনে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তরের পক্ষে তেমন আগ্রহ ও উৎসাহ দেখিতে পাননা৷ শিল্প যেখানে প্রায় নিশ্চিহ্ণের পথে, তখন এই শিল্প দপ্তর, শিল্প উন্নয়ন নিগম ইত্যাদি পুষিতে বছরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হইতেছে৷ অথচ শিল্পের দেখা নাই৷
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হইতে শুরু করিয়া তাবড় মন্ত্রীরা প্রতিনিয়ত বলিয়া বেড়াইতেছেন রাজ্যে শিল্পের ব্যাপক প্রসার ও উন্নতি হইবে৷ এতদিন বলা হইল যোগাযোগের অপ্রতুলতার কারনে শিল্পের কাঙ্খিত উন্নতি ও প্রসার লাভ হইতেছে না৷ বর্তমানে তো যোগাযোগের ক্ষেত্রে ত্রিপুরা অনেক বেশী সুবিধাজনক অবস্থানে চলিয়া আসিয়াছে৷ আগামী মার্চ এপ্রিল হইতে আগরতলা লামডিং ব্রডগেজ রেল চালু হইয়া যাইবে৷ আর যদি চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সুবিধা জুটিয়া যায় তাহা হইলে ত্রিপুরা তো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিবে৷ সুতরাং ত্রিপুরার স্বর্ণোজ্জল দিনের দেখা সহসাই মিলিয়া যাইবে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই৷ কথায় আছে ‘সবুরে মেওয়া ফলে৷’ স্বর্ণোজ্জল ত্রিপুরার স্বপ্ণেই তো মানুষ বুক বাঁধিয়াছে৷ এই স্বপ্ণ দেখাইয়াছেন ডঃ মনমোহন সিং হইতে শুরু করিয়া অনেকেই৷ প্রশ্ণ উঠিয়াছে, ত্রিপুরার উন্নয়ন ও শিল্প প্রসার বিষয়ে৷ একথা ঠিক, ত্রিপুরায় অধিকাংশ মানুষই ছিন্নমূল উদ্বাস্তু৷ দারিদ্রের করাল অভিশাপে জর্জরিত এরাজ্যে এক সময় পাকাবাড়ী ছিল না বলিলেই চলে৷ ছনবাঁশের ঘরই ছিল সম্বল৷ এখন এইসব আর চোখে পড়ে না৷ দারিদ্র দূরীকরণে বিভিন্ন প্রকল্প এক্ষেত্রে কিছুটা হইলেও সাফল্য আনিয়াছে৷
ত্রিপুরায় দারিদ্রসীমার নীচে বসবসাকারীর সংখ্যা কমিয়া আসিয়াছে বলিয়া সরকারী পরিসংখ্যানে দাবী করা হইয়াছে৷ কিন্তু, এক্ষেত্রেও ছলচাতুরী চলিতেছে৷ অনেক বিত্তবানরাও দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী হিসাবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিতেছেন৷ এই অবস্থার সহসাই অবসান না হইলে দারিদ্র সীমার নীচে প্রকৃতই যাহারা রহিয়াছেন তাহাদের বঞ্চিত করা হইবে৷ যাহারা মিথ্যা তথ্য দিয়া সরকারের এই সুবিধা নিতেছেন তাহাদের চিহ্ণিত করিয়া উপযুক্ত শাস্তি দিতে না পারিলে অপরাধ প্রবণতা রোখা যাইবে না৷ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরার উন্নয়ন সারা দেশেই মডেল হইতে পারে৷ এই লক্ষ্যে কাজ করিবার যে সুযোগ এখানে আছে তাহা তো অন্যান্য অনেক রাজ্যে অনুপস্থিত৷ এখানে উগ্রপন্থার সমস্যা এখন নাই বলিলে চলে৷ এখানে ‘দুর্নীতি আছে কিন্তু ইহার অবাধ স্বাধীনতা’ নাই৷ যাহা অন্যান্য রাজ্যে খুব নগ্ণভাবে দেখা যায়৷
এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা নাই৷ এখানে ‘স্থায়ী’ সরকার প্রতিষ্ঠিত৷ অন্যান্য দলগুলি এখানে সহসাই মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে যে পারিবে না তাহা প্রায় স্পষ্ট৷ এরাজ্যে বিশাল ভবন, রাস্তা ঘাট ঝকঝক তকতক অবস্থায় আছে৷ গ্রামীণ ও পাহাড়ী এলাকায়ও পাকা সড়ক উন্নয়নেরই দ্যোতক৷ কিন্তু, কথায় আছে চকচক করিলেই সোনা হয় না৷ খাঁটি সোনা চাই৷ সেই সোনার ত্রিপুরা গড়িয়া উঠিলে এরাজ্যের মানুষের গর্বের সীমা পরিসীমা থাকিবে না৷
এরাজ্যের বেকার সমস্যার যদি সমাধান না হয়, কৃষি নির্ভর ত্রিপুরার কৃষকরা যদি উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পান, আর্থিক দূর্বলতা কাটাইয়া উঠিতে না পারে সেখানে উন্নয়নের দাবী নস্যাৎ হইয়া যাইবে৷ ত্রিপুরা আয়তনে ও লোকসংখ্যার অনুপাতে দেশের বড় রাজ্যগুলির একটি জেলারই সমান৷ প্রায় এগার হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ত্রিপুরার জেলা, মহকুমা ও ব্লকের ছড়াছড়ি৷ গ্রামীণ এলাকাকে পুরসভার অন্তর্ভুক্ত করায় নতুন করিয়া সমস্যা বাড়িয়াছে৷ এইসব এলাকার পুরসভার কোনও সুযোগ সুবিধা নাই৷ যেমন বলা হয় কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন৷ এইভাবে জোর করিয়া পাকানো কাঁঠাল তো বিস্বাদ লাগিবেই৷ ত্রিপুরার উন্নয়নের ঘটনাকে নিশ্চয়ই স্বাগত৷ কিন্তু অবাস্তব পদক্ষেপ, গণহারে বিকলাঙ্গ পুর পরিষদের জন্ম ঘোষণা করিয়া কি বাহবা কুড়ানো যায়? ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার দিয়া কোনও কৃতিত্ব নেওয়া যায়? সুতরাং বহিরঙ্গ দেখিয়া আনন্দে নাচিয়া উঠিয়া সাফল্যের কীর্তন নিঃসন্দেহে ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া কিছুই নহে৷ ত্রিপুরার মানুষ চাহিবেন সত্যিকারের উন্নয়ন, যাহাতে ত্রিপুরাবাসীর বুক গর্বে ফুলিয়া উঠে৷ আমাদের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, ত্রিপুরায় স্বর্ণযুগ চলিতেছে৷ ভাবিয়া চিন্তিয়া যে স্বর্ণযুগের কথা বলিয়াছেন তাহার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাইবে না৷ কারণ প্রশ্ণ হইতেছে উন্নয়ন৷ আর উন্নয়নের স্রোতধারা বহিতেছে তাহাও লক্ষ্য করিবার বিষয়৷ রাজ্যের মানুষের সোনার ত্রিপুরার স্বপ্ণ দেখিবার অধিকার নিশ্চয়ই আছে৷ সেই স্বপ্ণ যেদিন বাস্তবের মাটি পাইবে সেদিনই ত্রিপুরাকে দেশবাসী নতুন করিয়া চিনিবে৷ এ বিষয়ে বোধহয় কোন সন্দেহ নাই৷
2016-01-03