মহালয়ার সকাল – শহরে উপচে পড়া ভিড়, তর্পনের মধ্য দিয়ে পিতৃপুরুষকে স্মরণ

আগরতলা, ২১ সেপ্টেম্বর: আজ মহালয়া। এই দিন থেকেই শুরু হয় দেবী পক্ষের আনুষ্ঠানিক সূচনা। শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে মহালয়ার দিনটি বাঙালির জীবনে এক বিশেষ আবেগের স্থান দখল করে আছে। ভোর থেকেই রাজধানী আগরতলায় তার বিশেষ আমেজ চোখে পড়েছে। আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ, শরতের হিমেল বাতাস আর কাশফুলের দোলায় যেন উৎসবের আগমনী বার্তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন স্থানে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। ভোরের আলো ফুটতেই অনেকেই বেরিয়ে পড়েন প্রাতঃভ্রমণে। হাওয়ায় মিশে থাকে ভোরবেলার ভক্তিমূলক সংগীতের সুর, মায়ের আগমনের আবহ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। রেডিও, টেলিভিশনে ভেসে আসা চণ্ডীপাঠের ধ্বনি যেন শহরের প্রতিটি কোণে উৎসবের আবেশ ছড়িয়ে দেয়।

সাত সকালে আজ আগরতলার কলেজ টিলা এলাকার প্রাত ভবনে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। ভোর থেকেই সাধারণ মানুষ জমায়েত হন দেবীপক্ষের সূচনা উপলক্ষে। সবার মুখে একটাই কথা— “মহালয়া মানেই পূজোর আগমন।” তবে অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, আগের মতো ভোর রাতে রেডিওতে বীরেন্দ্রকিশোর ভদ্রের কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী শোনা এখন আর হয় না। সময় বদলেছে, কিন্তু মহালয়ার সঙ্গে মানুষের আবেগ আজও অটুট।

প্রতিবারের মতো এদিন রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মীনারায়ণ বাড়ির দিঘি সহ বিভিন্ন দীঘি ও ঘাটে অনুষ্ঠিত হয় তর্পণ। সকাল থেকেই ঘাটে তর্পনের জন্য মানুষ ভিড় জমায়। দেবীপক্ষের আগে ১৫ দিন ধরে চলে পিতৃপক্ষ। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথি থেকে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথি হল পিতৃপক্ষের সময়। তারপরেই শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ। পিতৃপক্ষের সময় পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা হয়, তাঁদের সন্তুষ্ট করার জন্য এবং আত্মার শান্তির জন্য, তর্পণ, পিন্ড দান, শ্রাদ্ধ কর্ম করা হয়ে থাকে। শাস্ত্র মতে, পূর্বপুরুষরা এই সময়ে মর্ত্যে নেমে এসে তাঁদের বংশধরদের থেকে জল গ্রহণ করেন। সেই দিকে লক্ষ রেখে আজ সকাল থেকেই বিভিন্ন দিঘী তথা জলাশয়ে দেখা যায় পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার দৃশ্য। ভোর রাত্রি থেকেই লক্ষ্মীনারায়ণ বাড়িতে ভিড় জমে যায় তর্পনের জন্য।পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণে পরিবেশ ভরে ওঠে এক বিশেষ আধ্যাত্মিকতায়। অনেকে তাদের প্রয়াত আত্মীয়-স্বজনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অঞ্জলি দেন, জল ও নৈবেদ্য নিবেদন করেন।

শুধু তর্পণ নয়, মহালয়ার এই দিনে মানুষের মধ্যে উৎসবের আনন্দও চোখে পড়ে। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন। শিশু থেকে বৃদ্ধ – প্রত্যেকের মনে আজ এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। আগরতলার রাস্তাঘাটে, পার্কে, এমনকি চায়ের দোকানেও মহালয়ার আলোচনা জমে ওঠে। কে কোথায় পূজা দেখতে যাবে, কাদের সঙ্গে দেখা হবে, সবকিছু নিয়েই চলতে থাকে হাসি-আড্ডা।

অন্যদিকে মৃৎশিল্পীদের ব্যস্ততা তুঙ্গে। প্যান্ডেলে দেবী দুর্গার মূর্তি গড়ার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। শেষ মুহূর্তের রঙ তুলির টানাটানিতে ব্যস্ত শিল্পীরা। মহালয়ার দিনটিই তাদের কাছে এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, কারণ এই দিন থেকেই যেন পূজার চূড়ান্ত প্রস্তুতির রেশ শুরু হয়।
সব মিলিয়ে, মহালয়া শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক বিশাল সাংস্কৃতিক আবেগ। আগরতলার প্রতিটি কোণ আজ যেন উৎসবের রঙে রঙিন, ভরে আছে আনন্দ, আবেগ আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে।