কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক ভাবে বঞ্চিত করার চেষ্টা করছে রাজ্যগুলিকে ঃ মুখ্যমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৮ ফেব্রুয়ারি৷৷ রাজ্যের সামগ্রীক অগ্রগতির লক্ষ্য নিয়েই এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে৷ তাতে রাজ্যের গরীব, পিছিয়েপড়া, নির্যাতিত অংশের মানুষই বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে৷ এই বাজেট জনমুখী৷ আরও টাকার সংস্থান রেখে এই বাজেট প্রণয়ন করতে পারলে আরও ভাল হতো৷ বিধানসভা অধিবেশনের দ্বিতীয়ার্ধে আজ ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জন্য পেশ করা বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার একথা বলেন৷

২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জন্য পেশ করা বাজেট প্রস্তাবের উপর সাধারণ আলোচনা আজ শেষ হয়েছে৷ শিক্ষামন্ত্রী তপন চক্রবর্তী, বিদ্যুৎ মন্ত্রী মানিক দে, অর্থমন্ত্রী ভানুলাল সাহা, সমাজ কল্যাণ সমাজ শিক্ষা মন্ত্রী বিজিতা নাথ আজ সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন৷ প্রস্তাবিত বাজেট সমর্থন জানিয়ে আলোচনা করেন৷ আলোচনায় অংশ নেন বিরোধী দলের সদস্য গোপালচন্দ্র রায়, বিশ্ববন্ধু সেন এবং প্রণজিৎ সিংহ রায়৷ তারা প্রস্তাবিত বাজেটের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন৷

আলোচনায় অংশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যে দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলার চেষ্টা করছে তাতে অর্থনৈতিক এবং আরও বিভিন্ন দিক দিয়ে রাজ্যগুলিকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করছে৷ ছোট মাঝারি রাজ্যগুলির পক্ষে বাজেটের মাধ্যমে তাদের রাজ্যের মানুষের চাহিদা পূরণ করা কঠিন৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্যের জনগণের উপর সরকারের আস্থা আছে৷ জনগণেরও আস্থা বিশ্বাস আছে সরকারের উপর৷ তাই সবার সহযোগিতা নিয়েই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার সাফল্য পাচ্ছে৷

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্য বড় মাঝারি শিল্প কারখানা নেই এটা ঘটনা৷ তাই সরকারি চাকরির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়৷ তথ্য দিয়ে তিনি জানান, ১৯৭৯ সালে রাজ্যে সরকারি কর্মচারির সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ১৬৭ জন৷ তথ্য অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ পর্যন্ত রাজ্যে কর্মচারির সংখ্যা ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ১৫৫ জন৷ পেনশনার আছেন ৫৭ হাজার ৪০৬ জন৷ হিসেব করলে দেখা যাবে ১৯৭৯ এর পর থেকে গড়ে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার চাকরি হয়েছে৷ এর বাইরে ২০১৬ এর মার্চ পর্যন্ত রাজ্যে ৩৪৪৭টি রেজিষ্টার্ড ইউনিটে ৫৭ হাজার ৮২৬ জন কাজ করছেন৷ তাছাড়া আন রেজিস্টার্ড ইউনিটতো আছেই৷ এর পরও রাজ্যে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে৷ বাস্তবতা অস্বীকার করা যায়না৷

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সারা পৃথিবীতেই মন্দা চলছে৷ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমছে৷ তাই আমরা চাইলেই হঠাৎ করে রাজ্যে শিল্প আসবেনা৷ তিনি বলেন, বিভিন্ন বিদ্যালয়ে এনরোলমেন্ট কমেছে তা সঠিক নয়৷ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, রাজ্যের জন্ম হার কমেছে৷ স্বাভাবিকভাবে সুকল ভর্তি হওয়ার মতো ছাত্রের সংখ্যাও কমছে৷ এর পরও সুকলে ভর্তি হতে পারে এমন শিশুদের ৯৮.৪৯ শতাংশ সুকলে ভর্তি হয়েছে৷ যারা সুকলে ভর্তি হয়নি তাদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে৷ তাদের জন্য বাড়িতে গিয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ বিদ্যালয় চলো অভিযানেও খুব ভাল সাফল্য পাওয়া গেছে৷

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রেল সাব্রুম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে৷ রাজ্য সরকার চাইছে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত তা এগিয়ে নিতে৷ বাংলাদেশের আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহারের সুযোগও রাজ্য সরকার নিচ্ছে৷ বর্তমানে রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত রয়েছে৷ উৎপাদন আরও বাড়বে৷ এসব তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, রেল, সড়ক যোগাযোগ এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা একত্রিত হলে আশা করা হচ্ছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাজ্যের পরিস্থিতির পরিবর্তণ আসবে৷ তিনি আশা প্রকাশ করেন এই বাজেট বাস্তবায়িত করতে সবাই আন্তরিক ভূমিকা গ্রহণ করবেন৷ ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জন্য বাজেট প্রস্তাবকে সমর্থন করে শিক্ষা মন্ত্রী তপন চক্রবর্তী বলেন, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে এক বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিফলন ঘটেছে এই বাজেটে৷ ত্রিপুরাকে দ্রুত সমৃদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা তার প্রতিফলন হল এই বাজেট৷ তিনি বলেন, ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্যে আমরা এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছি৷ কেন্দ্রীয় বাজেটের সাথে রাজ্য বাজেটের তুলনা করে দেখছেন মানুষ৷ এই বাজেট জনমুখী, কল্যাণমুখী ও উন্নয়নমূখী৷

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, রাজ্যে শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে৷ তার প্রতিফলন রয়েছে এই বাজেটে৷ ১৯৭৮ থেকে আমাদের সরকার বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে৷ এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ এবারের বাজেটেও শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে ২১.২৩ শতাংশ৷

তিনি বলেন, শিক্ষা হল মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান ক্ষেত্র৷ মানব সম্পদের বিকাশ না হলে দেশ বা কোন রাজ্য এগিয়ে যেতে পারবেনা৷ তিনি বলেন, বুনিয়াদি, বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা সবক্ষেত্রেই যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ সকলের জন্য শিক্ষা এই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই রাজ্য সরকার শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে গুরত্ব দিয়েছে৷ তিনি বলেন, কেন্দ্রের নতুন সরকার আবারও জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে শুরু করেছেন৷ তার খসড়া তৈরী করা হয়েছে৷ এতে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে৷ এতে যাদের হাতে অর্থ ও সম্পদ আছে তারাই শিক্ষার সুযোগ নিতে পারবে৷ এখানেই কেন্দ্রের সাথে রাজ্য সরকারের মৌলিক পার্থক্য৷

বাজেট প্রস্তাবকে সমর্থন করে বিদ্যুৎ ও পঞ্চায়েত মন্ত্রী মানিক দে বলেন, উদারিকরণের নামে, কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকার যখন দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে তখন এক বিপরীত মুখী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে রাজ্যে জনমুখী বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে৷ বিদ্যুৎ মন্ত্রী বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নীতির ফলে ব্যাঙ্কগুলি রুগ্ণ হচ্ছে৷ রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে৷ বেকার সমস্যার তীব্রতা বাড়ছে৷ কর্মচূ্যতি ঘটছে৷ আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় আঘাত নেমে আসছে৷ এই পরিস্থিতিতে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এই বাজেট পেশ করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, রাজ্য সরকারের প্রধান দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে দারিদ্রতা দূরীকরণ, সেচের ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ছাড়া কৃষির উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয় তেমনি বিদ্যুৎ ছাড়া সেচের অগ্রগতির হবে না৷ তাই রাজ্যে বিদ্যুৎ পরিষেবার সম্প্রসারণ করা হচ্ছে দ্রুততার সাথে৷ রাজ্যে বিদ্যুৎ দপ্তরের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, রাজ্যের ১০৬৯৮টি বসতির মধ্যে ১০ হাজার ২৮০ টি বসতিতে বিদ্যুতায়ণ হয়েছে৷ তিনি বলেন, বিরোধী দলের বিধায়কগণ রাজ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতির যে কথা বলছেন তা সঠিক নয়৷ বিরোধিতা করার জন্যই এসব বলছেন৷ তিনি বলেন, রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে৷ মানুষ এখন উন্নয়নে অংশীদার হয়েছেন৷ এতেই সাফল্য আসছে৷ বাজেট প্রস্তাবকে সমর্থন করে সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা মন্ত্রী বিজিতা নাথ বলেন, কেন্দ্রের নতুন সরকার গত তিনটি বাজেটে জনকল্যাণে কোন দিশা দেখাতে পারেনি৷ কিন্তু আমাদের রাজ্যের এই বাজেটে সব অংশের মানুষের স্বার্থরক্ষা করার প্রতিফলন রয়েছে৷ এই বাজেট উন্নয়নমুখী৷ তিনি বলেন, সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তর রাজ্যের মানব সম্পদ উন্নয়নে কাজ করছে ধারাবাহিক ভাবে৷ তিনি দপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প ও সামাজিক ভাতাগুলির কথা উল্লেখ করে বলেন, সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে রাজ্য সরকার দুর্বল অংশের মানুষের কল্যাণে কাজ করছে৷ সুকল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞান সচেতনতা বাড়াতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান৷

আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থমন্ত্রী ভানুলাল সাহা বলেন, গরীব, নিম্নবিত্ত অংশের মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে একটি দায়বদ্ধ কর্মসূচি হিসেবে এই বাজেট পেশ করা হয়েছে৷ এই বাজেটের মধ্যে মানুষের জন্য কাজ করার দায়বদ্ধতা রয়েছে৷ তিনি বনে, চলতি অর্থ বছরের বাজেটের মাধ্যমে রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের কাছে কোন না কোন ভাবে সাহায্য পৌঁছানো গেছে৷ তথ্য উল্লেখ করে তিনি জানান, জাতীয় সংগ্রহ থেকে অর্থ পাওয়া রাজ্যের অধিকার৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে৷ প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, অনেকে গরীব অংশের মানুষের ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাবে উষ্মা প্রকাশ করেছেন৷ তাদের দৃষ্টিভঙ্গী হলো গরীবদের সাহায্য করা যাবেনা৷ যতই বাধা আসুক রাজ্য সরকার তার লক্ষ্য থেকে সরে আসবেনা৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *