ইহা এখন বহু চর্চিত৷ শিশু পাঠ্যের সেই সুর আজও কত ভাস্বর তাহা আর বলিবার অপেক্ষা রাখে না৷ ‘লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়৷’ এ রাজ্যে বামফ্রন্টকে তো জনগণই ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্টিত করে বার বার৷ সুতরাং স্বীকার করিতেই হইবে, জনগণের সমর্থনের জোয়ার বামফ্রন্টকে উজ্জীবিতই করিয়া রাখিয়াছে৷ এত জন ঢল যে দলের পিছনে সেই দল বা ফ্রন্টের রাজত্বে স্বাস্থ্য পরিষেবা মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিতেছে না কনে৷ সরকারী তথ্যেই জানা গিয়াছে, এক বছরে শুধু জিবি হাসপাতাল হইতেই ১৭৯২ জন রোগীকে বহির্রাজ্যে রেফার করা হইয়াছে৷ রেফার ছাড়া রাজ্য হইতে বহির্রাজ্যে চিকিৎসার জন্য রোগী গিয়াছেন আরও কয়েকগুন৷ বিশেষ করিয়া সংকটাপন্ন রোগীদের বেশীর ভাগই বহির্রাজ্যে নিতে না পারার কারণে, প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই মারা গিয়াছেন৷ রাজ্যে ‘বিশ্বমানের’ হাসপাতাল বলিয়া মিথ্যা ঘোষণা দেওয়া বেসরকারী হাসপাতাল হইতে বহির্রাজ্যে রোগী রেফার করা হইয়াছে৷ বহির্রাজ্যের একটি সংস্থাকে বিশ্বাস করিয়া আবার ঠকিয়াছে রাজ্য সরকার৷ মুখে তাহা রাজ্য সরকার স্বীকার করুন বা নাই করুন ইহাই বাস্তব৷ ‘ধান খাইয়াছে মুরগী যাইবে কোথায়?’ রাজ্য সরকারের সঙ্গে ওই বেসরকারী হাসপাতালের নিশ্চয়ই কোনও রফা চুক্তি হইয়াছে৷ তাহা না হইলে একের পর এক গর্হিত কাজ করিয়া এই হাসপাতালটি রেহাই পাইয়া যাইতেছে কি করিয়া? এক দিকে রোগীদের পকেট কাটা, অন্যদিকে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় একের পর এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনা সত্বেও হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার পিছনে কোথায়ও দূর্বলতা কাজ করিতেছে সন্দেহ নাই৷ এই হাসপাতালে ক্ষমতাসীন দলের রাজ্য সম্পাদকের অনুজ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িয়াছেন৷ খোদ রাজ্য সম্পাদক প্রকাশ্যে, শোক সভায় ওই বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে আঙুল তুলিয়াছেন৷ যদি ত্রিপুরায় একটি উন্নতমানের হাসপাতাল গড়িয়া উঠিত তাহা হইলে এইভাবে বেঘোরে রোগীকে মরিতে হইত না৷ প্রকাশিত সংবাদে জানা গিয়াছে, সাম্প্রতিক কালে বহির্রাজ্যে নিতে না পারার কারণে বেশ কয়েকজন জটিল রোগীকে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িতে হইয়াছে৷ বহির্রাজ্যে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় সমস্যা স্ট্রেচারে রোগী নেওয়ার সুবিধা আছে এমন বিমানের টিকিট পাওয়া৷ প্রকাশিত সংবাদে বলা হইয়াছে, গত ডিসেম্বর মাসে ভিড়ের কারনে, টিকিটের তীব্র সংকটে এয়ার ইন্ডিয়া সময়মতো স্ট্রেচারে রোগী নিতে না পারার কারনে, রাজ্যের সংকটাপন্ন বহু রোগী বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িলেও কল্যাণকামী সরকারের এবিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া নাই৷ প্রতিদিন রাজ্য হইতে যেভাবে রোগীরা বহির্রাজ্যে পাড়ি দিতেছেন তাহাতে রাজ্যে চিকিৎসা পরিষেবা নিয়া গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়াছে এবং গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হইয়াছে৷ জানা গিয়াছে , গত এক বছরে বিমানে স্ট্রেচারে তিন শতাধিক রোগীকে বহির্রাজ্যে পাঠানো হইয়াছে৷ এই তথ্য রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল অবস্থার চিত্রই বলিয়া দিতেছে৷
দুই দুইটি মেডিকেল কলেজ যে রাজ্যে আছে, সেখানে চিকিৎসা পরিষেবার এত বেহাল অবস্থার উন্নয়নে মাঝে মাঝে সরকারী স্তরে ঘোষণা দেওয়া হয়৷ কিন্তু যতখানি বলা হয়, জনগণকে যতখানি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তাহার সিকি ভাগও রূপায়ন হয় কিনা বুঝা মুশকিল৷ লক্ষ্য করিবার বিষয়, ত্রিপুরার মানুষকে কত স্বপ্ণ দেখানো হইতেছে৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পর্য্যন্ত রাজ্য সফরে আসিয়া বলিয়া গেলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সিংহদূয়ার হইবে ত্রিপুরা৷ বিভিন্ন প্রকল্পের রূপায়নে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা রাজ্য সরকারের কাজে বাহবা দিতে কসুর করিতেছেন না৷ ত্রিপুরার উন্নয়নকামী মানুষ ইহাতে গর্ববোধ করেন৷ ত্রিপুরার উন্নয়ন অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় চোখে পড়ার মতোই৷ কিন্তু, গরীব সাধারণ মানুষের সামনে চিকিৎসার ক্ষেত্রে যদি শোচনীয় সংকট থাকে, সরকারকে সেখানে ব্যর্থতাই কুড়াইতে হয়, সেখানে কী বলা হইবে? রাজ্যে দুই দুইটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে কিন্তু জটিল রোগের চিকিৎসক নাই, এর চাইতে তো দূর্ভাগ্যের কিছু হইতে পারে না৷ আজ হার্টের রোগের সমস্যা ক্রমেই বাড়িতেছে৷ অথচ রাজ্যে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাই৷ ডিপকার্ড দিয়া কাজ চালানো হইতেছে৷
সম্প্রতি, মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলিয়াছিলেন বেশী মাস মাহিনা দিয়া হইলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের রাজ্যে আনিতে হইবে৷ শুধু তাই নহে, রাজ্যের যেসব চিকিৎসক বহির্রাজ্যে কর্মরত তাহাদের তালিকা তৈরীরও নির্দেশ দিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ এইসব নির্দেশ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, রাজ্যের চিকিৎসা পরিষেবার যে সংকট তীব্রতর, তাহার নিরসন কিছুমাত্র হইয়াছে মনে হইল না৷ রাজ্য সরকারকে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নে কিভাবে কি পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেই বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷ রাজ্যের উন্নয়ন নিয়া যে প্রচার জাতীয় স্তরে দেখা গিয়াছে সেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফিরাইতে না পারিলে ‘মডেল’ রাজ্যের দাবী কোনও ভাবেই গ্রাহ্য হইবে না৷ চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যে মানবিক চেতনা ও উপলব্ধি জড়াইয়া আছে তাহাকে খাটো করিয়া দেখিবার কোনও সুযোগ নাই৷ রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারকে এই স্বাস্থ্য পরিষেবার সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করিতেই হইবে৷ আর এক্ষেত্রে যদি বাম সরকার সফল হইতে পারেন তাহা হইলে সারা দেশে নজীর হইয়া থাকিবে৷ ত্রিপুরার বহু রোগীরা সারা ভারতেই বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটিয়া যাইতেছেন৷ গরীব অংশের মানুষ এই বিপুল ব্যয়ভার সামলাইতে গিয়া সর্বস্বান্ত হইতেছেন৷ অনেক রোগী চিকিৎসা করাইতে না পারিয়া মৃত্যুকেই বাছিয়া নিয়াছেন৷ এই জটিল পরিস্থিতির হাত হইতে রাজ্যের রোগীদের রক্ষা করিতে, রাজ্যেই উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে জরুরী উদ্যোগ নিতেই হইবে৷ তাহা মাত্রাতিরক্তি ব্যয়সাধ্য হইলেও রাজ্য সরকার কার্য্যকরী উদ্যোগ নিলে মানবতার ইতিহাসে তাহা স্বর্ণাক্ষরে উল্লেখ থাকিবে৷
2016-01-11