ওয়াশিংটন/নয়াদিল্লি, ৯ আগস্ট : বিশ্বের দুই বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র — যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিক উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে ৫০% শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। এই সিদ্ধান্ত ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ককে নতুন করে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
গত ৬ আগস্ট, হোয়াইট হাউজ ঘোষণা করে যে ভারতীয় রফতানির ওপর ২৫% অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করা হবে, যার ফলে বিদ্যমান ২৫% শুল্কের সঙ্গে মিলিয়ে মোট শুল্কের হার দাঁড়াবে ৫০%। এই শুল্কের অর্ধেক ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে এবং বাকি অর্ধেক আগামী ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, এই শাস্তিমূলক পদক্ষেপের কারণ ভারত কর্তৃক রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি অব্যাহত রাখা।
হোয়াইট হাউজের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো এক বিবৃতিতে বলেন, “এটি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। আমরা চাই ভারত আমাদের জোটে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে, কিন্তু তারা তেল কেনা বন্ধ করছে না।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের ওপর এই শুল্ক চাপানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, অন্যদিকে ভারতের সার্বভৌম অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, “অন্যান্য বহু দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করে, তবে শুধু ভারতকে লক্ষ্য করে এই শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করা অত্যন্ত দুঃখজনক ও পক্ষপাতদুষ্ট।” ভারতের বাণিজ্য সচিব দাম্মু রবি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ কোনও যুক্তিনির্ভর নয়। আমরা আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক প্রথা মেনে চলছি।”
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এও জানিয়েছে যে, শুল্ক ইস্যু থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান প্রতিরক্ষা ক্রয়ের আলোচনা থেমে যায়নি। এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রকল্পগুলো নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে অগ্রসর হচ্ছে।”
মার্চ ২০২৫ থেকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে, যার লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বর্তমান ১৯১ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য বাড়িয়ে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। এ পর্যন্ত পাঁচ দফা আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে।
তবে ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যতদিন না ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করছে ও শুল্ক ইস্যুতে আপোষে আসছে, ততদিন বাণিজ্য আলোচনা হবে না।
এমন সময়ে এই শুল্ক আরোপ করা হলো, যখন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল মস্কো সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রুশ সংবাদ সংস্থা আরআইএ জানিয়েছে, উভয় পক্ষ “কৌশলগত অংশীদারিত্ব” আরও গভীর করার ওপর জোর দিয়েছে।
রাশিয়া-ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়ার তেল বিক্রির বাজার সংকুচিত হলেও, ভারত তুলনামূলকভাবে কম দামে রাশিয়ার তেল কিনে দেশের অভ্যন্তরীণ জ্বালানি চাহিদা মেটাতে থাকে।
বিশ্বখ্যাত রেটিং সংস্থা এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, এই ৫০% শুল্ক বাস্তবায়িত হলে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে ৩০ বেসিস পয়েন্ট কমে প্রায় ৬%-এ নেমে আসতে পারে। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও পরিষেবা খাতের সক্ষমতা এই আর্থিক চাপে খানিকটা প্রশমন দেবে বলেও মুডিজ জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে “কৌশলগতভাবে বিপজ্জনক” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “ভারতের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক চাপানো রাশিয়াকে দুর্বল করবে না, বরং ভারতকে আরও বেশি করে রাশিয়া এবং চীনের দিকে ঠেলে দেবে।”
এক সাক্ষাৎকারে বোল্টন বলেন, “চীন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বড় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রেখে চলেছে এবং তার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর অভিযোগ উঠেছে — তথাপি ট্রাম্প চীনের প্রতি নমনীয়তা দেখাচ্ছেন, আর ভারতের প্রতি কঠোর হচ্ছেন। এই বৈষম্য ভারতীয় জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।”
তিনি একটি প্রবন্ধে লেখেন, “বন্ধু ও শত্রু উভয়ের ওপর একইভাবে শুল্ক চাপিয়ে আমেরিকা তার দীর্ঘদিনের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “যদি চীন ভালো শর্তে চুক্তি করে, আর ভারত বঞ্চিত হয়, তাহলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারাতে বাধ্য।”
বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এক নতুন ও জটিল মোড়ে পৌঁছেছে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত সম্পর্কেও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত যদি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বন্ধ না করে, আর যুক্তরাষ্ট্র যদি তার কৌশলগত মিত্রদের সঙ্গে সংলাপের পথ বন্ধ করে দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে ব্রিকস জোটের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হতে পারে, যেখানে ভারত, রাশিয়া ও চীন একসঙ্গে অবস্থান করছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ এখন ভারতের — তারা কি রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বজায় রাখবে নাকি আমেরিকার শর্ত মেনে নেবে? কিংবা যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কি তার অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে আলোচনার পথ খোলা রাখবে?

