দুর্গাপুর, ২১ সেপ্টেম্বর(হি.স.): বয়স ৩২ বছর। ওজন ১৭ কেজি। উচ্চতায় তিন ফুট। বয়স বাড়লেও শারিরিক গঠন বাড়েনি। আর এটাই যেন পথের কাঁটা। নাবালক’ ভেবে টোটো চড়তে ভয় পায় যাত্রীরা। গরু ছাগল বেচে টোটো কিনে বিপাকে পড়েছে রাজু। বাবা- মা’র চিকিৎসা যেমন দু’বেলা খাবার জোগাড় করতে কালঘাম ছুটছে। তেমনই দুঃশ্চিন্তায় ঘুম উড়েছে রাজুর বাবা- মা’র। দুর্গাপুর- জেমুয়া রুটের টোটোচালক শেখ রাজু। লাউদোহার জেমুয়া গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর বাবা বছর ষাটে’র শেখ আহমেদ হোসেন। তিনি পেশায় একসময় মাছ বিক্রেতা ছিলেন। বার্ধ্যক্যের কারণে বছর পাঁচেক আগে মাছ বিক্রি ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে বিয়ের পর আলাদা থাকে। মেয়ের বিয়ে গেছে। রাজুর মা অসুস্থ। তারপর থেকে অনটনের সংসারে হাল ধরতে হয়েছে রাজু’কে। জেমুয়া ভাদুবালা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সে। সংসারের আর্থিক অনটনের কারণে মাঝ পথেই পড়াশোনায় ইতি টেনে গ্রামের মুদি দোকানে কাজ শুরু করে। কিন্তু সেখানেই মাস মাইনেতে সংসার চালানো মুশকিল ছিল রাজুর। আর তাই বাড়ির দুটি গরু ও চারটি ছাগল বিক্রি করে টোটো কেনে। রোজগারের আশায় টোটোয় একমাত্র ভরসা করে রাজু। জেমুয়া গ্রাম থেকে দুর্গাপুর ফুলঝোড় টোটো চালানো শুরু করে। এমনকি টোটো চালানো ভালই রপ্ত করে। জেমুয়া গ্রামের সদর বাজার ফুলঝোড় মোড় ছিল তার রুট। এপর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু যাদের আশায় টোটো কিনেছিল। সেই যাত্রীরা রাজুকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর পাঁচজন চালকের মতই যাত্রীদের ডাক দিলেও, মুখ ফিরিয়ে নেয় যাত্রীরা। প্রশ্ন এখানেই। অনেকে আবার মুখের ওপর বলেও দেয়, তুমি বাচ্চা ছেলে নিয়ে যেতে পারবে না। যাত্রীদের ভরসা দিতে কার্যত কালঘাম ছুটছে ৩২ বছরের রাজু’র। বয়স হলেও উচ্চতায় তিন ফুট, বাড়েনি শরীরে ওজন। তার শারিরিক গঠন যেন ক্লাস ফাইভ পড়া নাবালক। আর এই ‘বামন’ হওয়ায় পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজুর বাবা আহমেদবাবু বলেন, ” আমার ছোটো ছেলে রাজু। বছর কুড়ি আগে যখন বুঝতে পারলাম রাজু’র শারীরিক গঠন স্বাভাবিক হারে বাড়ছে না। তখন চিকিৎসা করাতে শুরু করি। দুর্গাপুরে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে চিকিৎসা করায়। পরে পূর্ব-বর্ধমান ও কলকাতায় চিকিৎসা করাতে নিয়ে যায়। শেষমেশ চিকিৎসার জন্য ব্যাঙ্গালোরেও নিয়ে যায়। তখন রাজু’র বয়স ১৯ বছর। ওখানকার চিকিৎসকরা বলেন, দেরি হয়ে গেছে। ৮ বছর বয়সে আনলে চিকিৎসা করা সম্ভব হত। তারপর থেকে রাজুর শারীরিক গড়ন একই রয়েছে। এখন রাজুই আমাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনকারি ভরসা।” তিনি আরও বলেন,” বাড়ির দু’টি গরু ও চারটি ছাগল বেচে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে পুরোনো একটি টোটো রিক্সা কিনে দিয়েছি। কিন্তু যাত্রীরা তার ওপর ভরসা করে চড়তে চাইছে না।”রাজু’র মা মঞ্জু বেগম বলেন,” স্বামী’র ও আমার দু’জনের শারীরিক সমস্যা রয়েছে। প্রতিমাসে প্রায় ৫ হাজার টাকার ঔষুধ লাগে। অনটনের সংসারে সব সময় ঔষধ জোটে না। শারীরিক কষ্ট সহ্য করে আছি। জমিজায়গা নেই। রাজুর টোটো চালিয়ে গড়ে খুব বেশি হলে প্রতিদিন শ’দুয়েক টাকা রোজগার হয়। ওই টাকা টোটো চার্জ ও মেরামতি করতেই শেষ হয়ে যায়। একেই তো ওর শারীরিক গড়ন দেখে কেউ টোটোতে চড়তে চাই না। তার মধ্যে ফুলঝোড় মোড় থেকে অন্য টোটো চালকরা যাত্রী তুলতে দেয় না। কষ্ট করে টোটো কিনে দিয়েও বিপাকে পড়েছি।” রাজু বলেন,” আগে ১৬ বছর ধরে গ্রামে মুদিখানার দোকানে কাজ করেছি। মাসে ৩ হাজার টাকা দিত। সংসার চলছিল না। তাই টোটো চালাচ্ছি। কিন্তু যাত্রীরা আমার ওপর ভরসা পায় না। যাত্রীদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু টোটো চালতে আমার কোনও সমস্যা হয় না। জেমুয়া গ্রামের সদর বাজার ফুলঝোড় মোড়। গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার। সেখানকার টোটো চালকরা আমাদের গ্রামের টোটো চালকদের যাত্রী তুলতে দেন না। সেখান থেকে যাত্রী পাওয়া গেলে হয়তো রোজগার ভালো হত।”