BRAKING NEWS

ক্যান্সার,অসংক্রামক ব্যাধি ও মুখ্যমন্ত্রী’র “মোকাবেলা”

ডা.কনক চৌধুরী

আমাদের প্রতিদিনের হাসপাতাল পরিসেবায় একজন স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে জীবন নিজেদের অসহায় বোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে যখন কিডনি,লিভার,হার্ট,ক্যান্সার রোগীরা খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে আউট পেশেন্ট কেয়ার বা ইনডোরগুলোতে হাজির হন। তারা মুমূর্ষ অবস্থায় আমাদের কাছে আসেন। এবং সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো এদের অনেকেই তরুণ-তরুণী বা কৈশোরের গন্ডি পার হননি।তাদের অনেকে জানেনই না যে তাদের কোন না কোন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ভীষণ ভাবে ইতিমধ্যেই অকেজো এবং রোগের কারণ সম্পর্কে রোগী ও পরিবার সম্পূর্ণভাবে অসচেতন। নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিজ বা অসংক্রামক ব্যাধি ভারত তথা সমগ্র পৃথিবীর জন্য একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।কোভিড পরিস্থিতিতে সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে আমরা আতংকিত হলেও অসংক্রামক ব্যাধি প্রায় ৬৭ শতাংশ রোগের কারন সারা পৃথিবী জুড়ে। ডায়াবেটিস,উচ্চ রক্তচাপ,স্থুলতা,শরীরে উচ্চমাত্রায় ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের প্রভাব,ক্যান্সার,মানসিক বৈকল্য, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ইত্যাদি দিনে দিনে আমাদেরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। যদিও এদেরকে এড়িয়ে যেতে,নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও এদের দ্বারা তৈরি হওয়া জটিলতার নিরসনে আমাদের সচেতনতা,নিয়মিতভাবে হাসপাতালে যাওয়া ও সফল জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি গুলোর বাস্তবায়নই সবচেয়ে জরুরী।সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের ৯০% মানুষের ধারণাই গোলমেলে ও প্রচলিত বিশ্বাসগুলো বিজ্ঞানসম্মত নয়। এইসবের উপর আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই ২০২২ এর ৬ই সেপ্টেম্বর থেকে ত্রিপুরা সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর ও জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের যৌথ প্রয়াসে শুরু হতে যাচ্ছে “মোকাবেলা” বা মুখ্যমন্ত্রী ক্যান্সার ও অসংক্রামক ব্যধি সনাক্তকরন ও লোক সচেতনতা অভিযান। এর মূল লক্ষ্য হবে ত্রিপুরার শহর ও প্রান্তিক জনগণের ক্যান্সার ও অসংক্রামক ব্যাধি’র প্রতিরোধ,দ্রুত সনাক্তকরন, চিকিৎসা ও জটিলতা নিরসন।এটি একটি মহতী উদ্যোগ এবং এই অভিযানের সঠিক প্রয়োগে আপমর জনসাধারণ দারুণ ভাবে উপকৃত হবেন।

আপনারা জানেন যে উচ্চ রক্তচাপ একটি গুরুতর চিকিৎসা সম্পর্কিত অবস্থা যা উল্লেখযোগ্যভাবে হার্ট, মস্তিষ্ক, কিডনি এবং অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্বব্যাপী ৩০-৭৯ বছর বয়সী আনুমানিক ১.২৯ বিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, বেশিরভাগ (দুই-তৃতীয়াংশ) নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বসবাস করেন।

চিন্তার বিষয় হলো,উচ্চ রক্তচাপের আনুমানিক ৪৬% প্রাপ্তবয়স্করা জানেনই না যে তাদের এই অবস্থা রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ সহ অর্ধেকেরও কম প্রাপ্তবয়স্কদের (৪২%) রোগ নির্ণয় করা হয় এবং চিকিৎসা করা হয়।উচ্চ রক্তচাপ যুক্ত প্রায় ৫ জনের মধ্যে মাত্র ১ জনের (২১%) এটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ বিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ।অসংক্রামক রোগের জন্য বিশ্বব্যাপী লক্ষ্যগুলির মধ্যে একটি হল ২০১০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ ৩৩% হ্রাস করা।

উচ্চ রক্তচাপের সাধারণ লক্ষণগুলি কী কী? উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয়
‘নীরব ঘাতক’। হাইপারটেনশনে আক্রান্ত বেশিরভাগ লোকই এই সমস্যাটি সম্পর্কে অবগত নন কারণ এতে কোনো সতর্কতা চিহ্ন বা উপসর্গ না-ও থাকতে পারে।এই কারণে,রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করাই অপরিহার্য।যখন উপসর্গ দেখা দেয়,যেমন,সকালের দিকে মাথাব্যথা,নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত ছন্দ,দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন এবং কানে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পারা ইত্যাদি।গুরুতর উচ্চ রক্তচাপে রোগীর ক্লান্তি,বমির ভাব,বমি,বিভ্রান্তি,উদ্বেগ,বুকে অস্বস্তি বা ব্যথা এবং মাংস পেশীর কাঁপুনি হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ সনাক্ত করার একমাত্র উপায় হল একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে দিয়ে রক্তচাপ পরিমাপ করানো। রক্তচাপ পরিমাপ করা দ্রুত,সহজ এবং ব্যথাহীন। যদিও আজকাল স্বয়ংক্রিয় ডিভাইস ব্যবহার করে নিজেদের নিজস্ব রক্তচাপ পরিমাপ করা যায়,তবুও একজন পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে এর মূল্যায়ন,ঝুঁকির সম্ভাবনা এবং সংশ্লিষ্ট অবস্থার ভিত্তিতে রোগীর চিকিৎসা,পথ্য ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা অত্যন্ত জরুরী। এভাবেই প্রতিটি অসংক্রামক ব্যাধির বর্তমান ও ভবিষ্যত জটিলতা সফলভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। একটি প্রশ্ন আপনাদের মনে আসতেই পারে।নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে উচ্চ রক্তচাপ কেন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা?উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বিভিন্ন অঞ্চলে এবং দেশের আয় ও গোষ্ঠীতে পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশনের আফ্রিকান অঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি (২৭%) যেখানে ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশনের আমেরিকান অঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ সবচেয়ে কম (১৮%)। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যা ১৯৭৫ সালে ৫৯৪ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে ১.১৩ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে এই বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে দেখা গেছে।এর কারণ হিসেবে প্রধানত সেই জনসংখ্যার উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকির কারণগুলির প্রতিনিয়ত বৃদ্ধিকেই দায়ী করা হয়।

প্রতিরোধের ব্যাপারে কিছু না বললেই নয়।এগুলো যদিও আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু,দুঃখের ব্যাপার হলো বেশির ভাগই মানি না ! দৈনিক লবণ খাওয়া কমানো (প্রতিদিন পাঁচ গ্রামের কম)।বেশি করে ফল ও সবজি খাওয়া।নিয়মিত শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা।তামাক ব্যবহার পরিহার করা।অ্যালকোহল সেবন কমানো।

স্যাচুরেটেড চর্বিযুক্ত খাবারের পরিমাণ সীমিত করা।খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট পরিহার করা ইত্যাদি। মানসিক চাপ কমানো এবং প্রতিদিন আধাঘন্টা সময় ধ্যান করা।নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা।উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা নিয়মিত ভাবে কাম্য ও সেইসাথে আনুসাঙ্গিক অন্যান্য রোগের চিকিৎসা ধরে রাখা।

কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করার জন্য ভারত সরকারের সাথে সাথে ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (US CDC) ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্লোবাল হার্টস ইনিশিয়েটিভ চালু করেছে, যার মধ্যে HEARTS প্রযুক্তিগত প্যাকেজ রয়েছে। HEARTS কারিগরি প্যাকেজের ছয়টি মডিউল হলো (১)স্বাস্থ্যকর-জীবনশৈলী পরামর্শদান, (২)প্রমাণ-ভিত্তিক চিকিৎসা প্রদান, (৩)প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা,(৪)ঝুঁকি-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা,(৫)স্বাস্থ্যদল ভিত্তিক যত্ন, এবং (৬) রোগীর চিকিৎসা পর্যবেক্ষণের জন্য পরিকাঠামো।গ্লোবাল হার্টস ইনিশিয়েটিভে অবদানকারী অন্যান্য অংশীদাররা হলো সিডিসি ফাউন্ডেশন,গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর, জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথ,প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন (পিএএইচও) এবং ইউএস সিডিসি।

ডায়াবেটিস নিয়ে কিছুটা না বললেই নয়। এ এমন এক রোগ যা সঠিক ভাবে ও সঠিক সময়ে নিয়ন্ত্রণে না রাখলে আপনার জীবন নিশ্চিত ভাবে করে তুলবে দুর্বিষহ। ব্যাপক এই চ্যালেঞ্জ।ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৯৮০ সালে ১০৮ মিলিয়ন থেকে ২০১৪ সালে ৪২২ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। উচ্চ-আয়ের দেশগুলির তুলনায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে প্রকোপ আরও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডায়াবেটিস থেকে অন্ধত্ব, কিডনির রোগ,হার্ট অ্যাটাক,স্ট্রোক এবং পায়ের রক্তচলাচলের ব্যাঘাত ও গ্যাংগ্রীন হয়ে থাকে।২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, ডায়াবেটিস থেকে অকালমৃত্যুর হার ৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। কি মারাত্মক এই রোগের প্রভাব!২০১৯ সালে ডায়াবেটিস রোগের জটিলতা বা সরাসরি ডায়াবেটিস থেকে আনুমানিক ১.৫ মিলিয়ন মৃত্যুর মধ্যে নবম প্রধান কারণ ছিল এই রোগ। একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য,নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ, শরীরের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা এবং তামাক ব্যবহার এড়ানো হল টাইপ টু ডায়াবেটিস প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করার মূল উপায়। ডায়াবেটিস চিকিৎসা করা যেতে পারে এবং এর পরিণতিগুলি খাদ্য, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ,ওষুধ এবং নিয়মিত স্ক্রীনিং এবং জটিলতার চিকিৎসার মাধ্যমে এড়ানো বা পিছিয়ে রাখা যেতে পারে।
আজকের এই সল্পপরিসর প্রতিবেদনে সবগুলো অসংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কে লেখার অবসর নেই।তবুও মনে রাখতে হবে উচ্চরক্তচাপ,ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার রোগের প্রতিরোধ অনেকাংশেই সম্ভব। এটা খুব বেশি জরুরি যেহেতু এদের জটিলতা ব্যাপকভাবে আমাদের হাসপাতাল, রোগীর পরিবার ও রোগীর জীবনে চাপ বাড়ায়। দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা বয়ে আনে রোগীর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে।এটা খুবই বেদনাদায়ক যে,মাত্র ৫% রোগী সুস্থ কিডনি নিয়ে একজন স্পেসিয়ালিস্ট ডাক্তারের কাছে আসেন! শুরু শুরুতেই আমরা সঠিকভাবে বা সর্বান্তকরণে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে চাই না। রোগ আছে জেনেও রোগের জন্য ওষুধ খাইনা,রোগের ব্যপারে পরবর্তী পরিকল্পনা করিনা,নিয়মিত ভাবে হাসপাতালে চেকআপ করাই না।

খুব অসুস্থ না হলে হাসপাতালের ত্রিসীমানায় আমাদের দেখা যায়না।

চতুর্দিকে মদ,বিড়ি,সিগারেট,মাদক দ্রব্য,তামাক সেবন,মানসিক অবসাদের ছড়াছড়ি।শহর ছাড়িয়ে উপশহর,সমতল থেকে পাহাড়ের কোলে ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন নেশার সামগ্রী।দিনে দিনে তা বাড়ছেই।অথচ সামাজিক জাগরণের খুব অভাব। পরিবার,বিদ্যালয়,অফিস,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,ক্লাবগুলোর ইতিবাচক সাড়া আজ ভীষণ জরুরী “মোকাবেলা”র মতন জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত অভিযানগুলোকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে।আমাদের আল্যোপাথিক,আয়ুষ বা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আরো বেশী সংখ্যায় চাই হাসপাতাল গুলোতে। আরো বিশেষজ্ঞ বা অতি-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার ত্রিপুরায়,কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে রাখবেন,সময় মতো চিকিৎসা,গন সচেতনতা ও লাগাতার ব্যবস্থাপনা ছাড়া উপরে উল্লেখিত ভয়াবহ পরিসংখ্যানগুলোকে আমরা মোকাবেলা করতে পারবো না।

কোন পরিমান স্বাস্থ্যকর্মীই এই বিশাল আকারের অসংক্রামক ব্যাধি ও ক্যান্সারের সনাক্তকরণ,প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবেন না। শুধুমাত্র আপনার,আমার ও সকলের উপলব্ধি,সাহায্য ও সরাসরি যোগদানই সফল করবে ত্রিপুরার “মোকাবেলা” স্বাস্থ্য অভিযানকে এবং গড়ে তুলতে পারে একটি সুন্দর,নেশামুক্ত,নীরোগ সমাজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *