BRAKING NEWS

কোভিড ব্রেক থ্রু ইনফেকশন (Breakthrough Infection) কি এবং কেন ?

ডা: কনক চৌধুরী

কোভিড ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ পাওয়ার পরেও আপনি কোভিড ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারেন,এমন কথা আমাদের ত্রিপুরাতেও চলছে। সুধী সমাজ অব্দি এটি নিয়ে আতংকিত আজ। এমনটা হওয়ার দরকার নেই বলেই চিকিৎসক ও বৈজ্ঞানিক মহলের অভিমত। যদিও কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরে এমন দাবি করা হয়েছে যে, লোকেরা দুটি ডোজ টিকা দেওয়ার পরেও কোভিড -১৯ পজিটিভ হয়েছে।
তবে, আসলেই কি, ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ পাওয়ার পরে ইতিবাচক বা পজিটিভ রেজাল্ট হতে পারে ? ভারত দ্রুতগতিতে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ কথা সত্যি যে এখানে ভ্যাকসিনের উভয় ডোজ দেওয়ার পরেও কিছু কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া গেছে।
আমার এই প্রতিবেদন আশা রাখি সামাজিক মাধ্যমে আপনাদের কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। কারন,দৈনিক পত্রিকা আজকাল সবাই পড়েন না। পত্রিকার ভিতরের পাতা আরো কম পড়েন।এইসব প্রেক্ষাপটে সামাজিক মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক তত্ত্ব খুঁজে দেয়া জরুরী এবং এই দায়িত্ব আমরা এড়াতে পারবোনা,শুধু সাধারনের উপর দোষ চাপানো অনেক সহজ। যাই হোক। যা বলছিলাম।
আমরা বলছিলাম “ব্রেক থ্রু” (Breakthrough infection) সংক্রমণ নিয়ে। তবে অসহায় বোধ করার কোন কারণ নেই। “ব্রেক থ্রু” সংক্রমণ জাতীয় ঘটনা খুব কমই ঘটে এবং এক্ষেত্রে লোকেরা কম গুরুতর কোভিড লক্ষণ দেখিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে এই জাতীয় ঘটনাগুলির সাথে কোভিড -১৯ ভ্যাকসিনের গুনগত মান বা ভ্যাক্সিন দেয়ার পদ্ধতির কোন সম্পর্ক নেই। আপনি কি ভ্যাকসিন দেওয়ার পরেও কোভিড পজিটিভ পরীক্ষিত হতে পারেন?
যদি পজিটিভ হন তবে আপনার কী করা উচিত? টিকা দেওয়ার পর আপনার কি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত? আসুন,সহজ বাংলায় ব্যাপারগুলো জানার চেষ্টা করা যাক। ‘ব্রেক থ্রু’ সংক্রমণ কী ? এর সাথে পুনঃসংক্রমণ (reinfection) এর তফাৎটা কোথায় ?
সহজ কথায়, যদি কোন ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়ার পরেও কোভিড -১৯ আক্রান্ত হন তবে এটি ব্রেক থ্রু সংক্রমণ হিসাবে পরিচিত। এটি নির্দেশ করে যে, কোনও ব্যক্তির ভ্যাকসিন থেকে খুব কম প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছিলো। তবে এ জাতীয় সংক্রমণ বেশিরভাগ উপসর্গহীন বা অ্যাসিম্পটমেটিক।
সব ধরনের ভ্যাকসিনের ব্রেক থ্রু সংক্রমণ হয়। তবে মনে রাখবেন, ব্রেক থ্রু সংক্রমণ পুনঃ সংক্রমণ থেকে পৃথক। আইসিএমআর(ICMR)এর মতে কমপক্ষে ১০২ দিনের ব্যবধানে কোভিড এর পুনরায় সংক্রমণকে পুনঃসংক্রমণ বলা হচ্ছে। মধ্যবর্তী সময়ে একটি টেস্ট হতে হবে নেগেটিভ।
কীভাবে কোনও টিকা দেওয়া ব্যক্তি কোভিড -১৯ এ সংক্রমিত হতে পারে?
বর্তমানে, কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
প্রথমত, এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে কোনও ভ্যাকসিন 100 শতাংশ কার্যকর নয় এবং সব ধরনের ভ্যাকসিনে ব্রেক থ্রু সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে।যদিও খুব কম। ভারতে জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া তিনটি কোভিড টিকার মধ্যে কোভিডিল্ড ভ্যাকসিন ৭০%, কোভ্যাক্সিন ৭৮%, এবং রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ৯২% করোনা প্রতিরোধে কার্যকর।
দ্বিতীয়ত, কোভিড -১৯ ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার দুই-তিন সপ্তাহ পরে অ্যান্টিবডিগুলির সুরক্ষামূলক স্তর সাধারণত বিকাশ লাভ করে। সুতরাং, এই সময়ের মধ্যে একজন সংক্রমিত হতে পারে।
তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো সুধী পাঠকগন,কোভিড রোগ বা ডিজিজ মানে হলো আপনার অল্প বা বিস্তর উপসর্গ আছে। কিন্তু পরীক্ষায় ধরা পড়া বা ইনফেকশন মানে কিন্তু তা নয়। ইনফেকশনের সময় আপনার ডিজিজ বা রোগের উপসর্গ নাও থাকতে পারে। এই বিষয় টা দয়া করে বোঝার চেষ্টা করবেন।
কোভিড -১৯ ভ্যাকসিন দিলে হালকা লক্ষণ, গুরুতর রোগ এবং হাসপাতালে ভর্তি অনেকাংশেই রোধ করা যায়। এটা টিকাকরণের আসল দিক। তবে সম্পূর্ণরূপে টিকা প্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষেও ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, প্রতিরোধ ক্ষমতা(ইমিউনিটি) এবং প্রতিরক্ষামূলক প্রতিরোধ ক্ষমতা(ইমিউনোজেনিসিটি)একে অপরের থেকে পৃথক।
ইমিউনোজিনিসিটি কেবল একটি জৈবিক প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়া উৎপাদন করাকে বোঝায়, যা প্রতিরক্ষামূলক হতে পারে না এবং এই কারনেই টিকাকরনের প্রতিরোধজনিত প্রতিক্রিয়ার উপস্থিতিতেও ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার পর কোভিড -১৯ সংক্রমণ থেকে ব্যক্তিটিকে রক্ষা করতে ভ্যাকসিনের ব্যর্থতা দেখা দেয়।
ব্রেক থ্রু সংক্রমণের পিছনে করোনাভাইরাস গুলোর বিভিন্ন স্ট্রেইনের ভূমিকা কেমন?
দ্বিতীয় তরঙ্গের ভাইরাসের নতুন এবং আরও বেশি সংক্রমণযোগ্য চেহারা দেখা গেছে। নতুন স্ট্রেইনগুলো সম্ভবত ভ্যাকসিনের মাধ্যমে তৈরি প্রতিরক্ষা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হতে পারে। এটা ভ্যক্সিনেশন পরবর্তী ব্যর্থতার একটি উত্তর বলে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আছে।
‘ডাবল মিউট্যান্ট’ ভাইরাস সম্পর্কিত কিছু ল্যাব প্রমাণ রয়েছে যা দেখায় যে এটি কিছুটা বেশি সংক্রমণযোগ্য এবং মানব দেহের ভ্যাক্সিন পরবর্তী অ্যান্টিবডিগুলি ভাইরাসগুলো আটকাতে আরও কঠিন সময়ের সম্মুখীন হতে পারে,তবে বিজ্ঞানীরা এখনও মূল্যায়ন করছেন এই ব্যাপারে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) এর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন যুক্তরাজ্যের মিউট্যান্ট করোনা’র বিরুদ্ধে কাজ করছে ।
ভারতে কতগুলি ব্রেক থ্রু সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে?
গত সপ্তাহে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) প্রকাশিত তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পর্যন্ত ১০.০০০ টি টিকা দেওয়া গোষ্ঠীর প্রায় দুই থেকে চার জন লোক আক্রান্ত হয়েছেন, যা খুব কম সংখ্যক। যদি আমরা এটিকে ভ্যাকসিনের ভিত্তিতে বিভক্ত করি, তবে কোভাক্সিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রাপ্ত প্রায় ০.০৪ % মানুষ
কোভিড-১৯ ব্রেক থ্রু পজিটিভ হয়েছেন। কোভিশিল্ড ভ্যক্সিন এর ক্ষেত্রে ০.০৩% এরও কম।
ব্রেক থ্রু সংক্রমণের পেছনের সম্ভাব্য কারণগুলি ব্যাখ্যা করে আইসিএমআর এর মহাপরিচালক বলরাম ভার্গভ একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “বর্তমানের অতি সংক্ষিপ্ত দ্বিতীয় তরঙ্গও এই শতাংশের হিসাবে ছোটখাট অবদান রাখতে পারে। অন্যথায় এটি হতে পারত শূন্য শতাংশ।” তিনি স্বাস্থ্যসেবী এবং প্রথম সারির কোভিড-১৯ কর্মীদের মধ্যে ব্রেক থ্রু সংক্রমণের আধিক্য খানিকটা বেশি বলে জানিয়েছেন। কারন, ভ্যক্সিনেশন হয়েছিলো প্রথম তাদেরই। দীর্ঘায়িত পেশাগত সংস্পর্শের কারণে তারা সংক্রমিত হয়েছেন বেশী।
এবার দেখা যাক, টিকা দেওয়ার পরে কি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?
সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া লোকের কোভিড সম্পর্কিত সুরক্ষা প্রটোকল গুলো মেনে চলা উচিত,যেমন মুখোশ বা মাস্ক পরা, অন্যের থেকে যথাযথ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড জায়গাগুলো এড়ানো এবং ঘন ঘন হাত ধোয়া।
যদি তারা টিকা দেওয়ার পরে কোভিড -১৯ পজিটিভ হয় তবে তাদের কী করা উচিত?
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোভিড -১৯ এর লক্ষণগুলো প্রকাশিত হলে,ওই ব্যক্তিকে অবশ্যই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে নিজেকে তাৎক্ষণিকভাবে আলাদা করতে হবে এবং চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এই জাতীয় ক্ষেত্রে, তাদের কোন আলাদা আচরণ করতে হবে না, টিকা দেওয়ার আগে রোগটির সংক্রমণ হলে যেমনটা করতে হতো, ঠিক ততটুকুই।
একটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষা ওই ব্যক্তির ভাইরাস নতুন সংক্রমিত হয়েছেন কিনা তা জানতে সহায়তা করবে (নাকি টিকা দেওয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া?) এবং লক্ষণগুলির তীব্রতা কেমন হতে পারে। অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল এবং সিটি ভ্যালু ইত্যাদির মাধ্যমে স্থির হবে চিকিৎসা পদ্ধতি এবং রোগী হাসপাতালে ভর্তি হবেন কিনা।
এই জাতীয় ব্রেক থ্রু ইনফেকশন কি অন্য দেশে রিপোর্ট করা হয়েছে?
ইউএস(US) সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন(CDC), তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত করেছে যে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড এর বিরুদ্ধে ৮ মিলিয়নেরও বেশি লোক পুরোপুরি ভ্যাকসিন নিয়েছিল। তাদের মধ্যে ৭১৫৭ জন টিকা দেওয়ার পর করোনা ব্রেক থ্রু আক্রান্ত হয়।এদের মধ্যে প্রায় ৩১% ছিল উপসর্গহীন।
উপরের আলোচনাটি দয়া করে মন দিয়ে পড়ুন। হঠাৎ কোনো দুঃখের খবরে অস্থির হবেন না। সঠিক খবর খুঁজে নিন ও এর উপরে ভাবুন।
কনক্লুশন ড্র করা বা কোনো বহুমাত্রিক বিষয়ে নিমিষেই পরিসমাপ্তি টেনে দেবেন না। নিজে জানুন। অপরকে জানান। একসাথে আমরাই জিতবো এই লড়াই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *