মুম্বইয়ে আপনি পিরোজশা গোদরেজ মার্গ দেখতে পারবেন। তিনি রাজনেতা, লেখক, স্বাধীনতা সংগ্রামী অথবা কবি নন। আমাদের দেশে সাধারণত সড়ক, স্টেডিয়াম, পার্ক প্রভৃতির নাম তাঁদের নামেই রাখা হয়। গোদরেজের সম্পর্ক মূলত গোদরেজ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তিনি মূলত ব্যবসায়ী ছিলেন এবং একজন ব্যবসায়ী হিসেবেই দেশ নির্মাণে মূল্যবান অবদান রেখেছে গোদরেজ। এটা খুব পুরানো কথা নয়, সেই সময় দেশের উদ্যোগপতিদের সম্মান করা হত। এখন সময় বদলেছে। বর্তমানে কিছু বিক্ষিপ্ত মানসিকতার মানুষজন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগপতিদের পিছনে পড়ে রয়েছে। আমি রিলায়েন্স এবং আদানি গ্রুপের বিষয়ে বলছি। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (আরআইএল) পেট্রোকেমিক্যালস, টেক্সটাইল, প্রাকৃতিক সম্পদ, খুচরা বাণিজ্য ও টেলিকম ক্ষেত্রে বড় ব্যবসা করে। রিলায়েন্স ভারতের অন্যতম লাভজনক সংস্থা। এর অর্থ হল রিলায়েন্সের কয়েক মিলিয়ন শেয়ারহোল্ডাররাও বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুনাফার অংশীদার। রিলায়েন্স লক্ষ লক্ষ পেশাদার মানুষ কাজ করেন। প্রত্যেকের বেতন এতটাই বেশি যে সকলেই ট্যাক্স দেন। একইভাবে লক্ষ লক্ষ শেয়ার হোল্ডার রয়েছে। রিলায়েন্স থেকে প্রতিবছর মোটা অংকের লাভ্যাংশ পান তাঁরা।
এবার একটু আদানি গ্রুপ সম্পর্কে বলা যাক। আদানি মূলত কয়লা বাণিজ্য, কয়লা খনন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদ কোম্পানি। আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গৌতম আদানি। দেশের বৃহত্তম এক্সপোর্ট কোম্পানির মধ্যে অন্যতম আদানি গ্রুপ। গৌতম আদানি জন্মেছিলেন আহমেদাবাদে, সাধারণ পরিবারে। গৌতম মিলিয়ে মোট ৭ ভাই-বোন। ফলে পড়াশোনা করার মধ্যেই অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বি কম-এ ভর্তি তো তিনি হয়েছিলেন, কিন্তু পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। ১৮ বছর বয়সেই অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি মুম্বই এসেছিলেন এবং একটি ডায়মন্ড কোম্পানিতে সামান্য টাকায় কাজ করা শুরু করেন। দু’বছর সেখানে কাজ করার পর গৌতম আদানি ঝভেরী বাজারে নিজস্ব ডায়মন্ড আউটফিট খোলেন। এরপর থেকেই তাঁর জীবনে নতুন ছন্দ আসে। ১৯৮১ সালে আদানির বড় ভাই মনসুখভাই আহমেদাবাদের প্লাটিকে একটি ইউনিট শুরু করেছিলেন এবং গৌতমকে কোম্পানি চালানোর কথা বলেছিলেন। এরপর তিনি দাদার পিভিসি ইউনিটের দায়িত্ব নেন এবং ধীরে ধীরে ব্যবসার প্রগতি হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট কোম্পানি আদানি এন্টারপ্রাইজের স্থাপনা করেন। এখন আদানি গ্রুপের ব্যবসা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
ধীরুভাই আম্বানি রিলায়েন্স সূচনা করেছিলেন এবং তা আকাশচুম্বী করেছেন তাঁর ছেলে মুকেশ আম্বানি। গৌতম আদানি তো প্রথম প্রজন্মের উদ্যোগপতি। তাঁকে দেখে উৎসাহিত হওয়া উচিত দেশের যুব সমাজের। কিন্তু, তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে খলনায়ক করা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। কিছু মনে করবেন না, আমাদের দেশেই এমনটা হচ্ছে।
ইউপিএ সরকারের আমলে ২০১৩ সালে কুমার মঙ্গলম বিড়লা গ্রুপের চেয়ারম্যান আদিত্য বিড়লার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছিল। ওই মামলায় কর্পোরেট ভারত হতবাক হয়ে গিয়েছিল। টাটা গ্রুপের প্রাণপুরুষ রতন টাটা, মাহিন্দ্রা এন্ড মাহিন্দ্রা প্রমুখ আনন্দ মাহিন্দ্রা, এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান দীপক পারেখের সমতুল্য ছিলেন তিনি। এর আগে কুমার মঙ্গলমের নাম কোনও বিবাদে জড়ায়নি। এই কারণে তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই চার্জশিট দায়ের করার পরই আলোড়ন পরে গিয়েছিল। আমরা যদি নিজ দেশের কর্পোরেট জগতের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যে’ অভিযোগ আনি, তাহলে বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি কলুষিত হবে। জানি না কেন, বিনা কোনও কারণে খ্যাতনামা শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হচ্ছে? আদিত্য বিড়লা গ্রুপের প্রায় ৪০ টি দেশে উপস্থিতি রয়েছে। কোটি কোটি টাকা ট্যাক্স দেয়, যা দেশের প্রগতির জন্য অত্যন্ত জরুরি। আপনারা হয়তো উপলব্ধি করেছেন, আমাদের দেশের একটি সমাজ, যাঁরা ধনীদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। তাঁদের ত্রুটি খুঁজে বের করে। লোকসভা, রাজ্যসভা অথবা বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যখন কোনও ধনী প্রার্থী নিজের সম্পত্তির বিবরণ দেন, তখন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। যাঁর সম্পত্তি ঠিক-ঠাক হয়, তাঁকে সন্দেহের নজরে দেখা হয়।
আমি যখন রাজ্যসভায় মনোনয়নের জন্য গিয়েছিলাম এবং নিজের উপার্জন ও সম্পত্তির সঠিক বিবরণ দিয়েছিলাম, তখন আমাকে সবথেকে ধনী সাংসদ বলা হচ্ছিল। একদিন আমরা সবাই সেন্ট্রাল হলে বসে গল্প করছিলাম। কংগ্রেসের একজন বড় নেতা ওয়েটারকে বলেছিলেন, আমাদের সঙ্গে যে কয়েকজন মাননীয় সাংসদ বসে রয়েছেন, তাঁদের বিল ওই দিকে দিয়ে দেবেন, এখানে দেশের সবথেকে ধনী সাংসদ বসে রয়েছেন। আমি বললাম, রাজা সাহেব, আপনার হুকুম শিরোধার্য। ওই কথায় আমি খুশিই হয়েছিলাম। আমি কোনও রাজ পরিবারের জন্মগ্রহণ করিনি এবং সাংবাদিকতার চাকরি ২৩০ টাকা বেতনে শুরু করেছিলাম, তাই আমার ভালো লেগেছিল। আমি কঠোর পরিশ্রমের পর উপার্জিত অর্থে ট্যাক্সও দিচ্ছি। যাঁর কাছে অধিক অর্থ থাকে, তাঁদেরই ছদ্মবেশী-নৈতিকতাবাদীরা ঘিরতে থাকে।
১৯৯১ সালের পর অর্থনৈতিক উদারকরণের কারণে দেশে দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। দেশের মাধ্যবিত্তরা দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন। নতুন নতুন শিল্পটি সামনে আসছেন। মূল কথা হল এই যে, আমরা কী কখনও কোনও উদ্যোগপতিকে সম্মান করব? উদাহরণ স্বরূপ ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নন্দন নীলেকেনি যাতে সংসদ না যেতে পারেন? ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু হেরে যান। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী রোহিণী প্রতি বছর মোটা অঙ্কের টাকা শিক্ষার প্রচার-প্রসারের জন্য খরচ করেন। এমন ধরনের ব্যক্তিত্বের কী সংসদ অথবা বিধানসভায় যাওয়া উচিত নয়? মনে হচ্ছে ধনীদের সর্বজনীন জীবনে আসা অনেকের পছন্দ নয়। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় মহাত্মা গান্ধী কোনও দরিদ্র পরিবার থেকে ছিলেন না অথবা পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু অথবা সুভাষ চন্দ্র বসু ধনী পরিবার থেকে ছিলেন। সৎভাবে অর্থ উপার্জন করা কী অপরাধ?
(লেখক রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ)