আর কে সিনহা
বৈশ্বিক মহামারি করোনার কাছে প্রায় পরাজিত হওয়া বিশ্বের সামনে নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। ব্রিটেনের বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির দাবি করেছেন। এই দাবির পরই মনে হচ্ছে যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল গোটা দুনিয়া। মনে হচ্ছে পৃথিবী এবং মানবতার উপর এই সঙ্কট শীঘ্রই শেষ হতে চলেছে। এখন বিশ্বের প্রতিটি মানুষ, শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই করোনাভাইরাসের প্রকোপে ভীত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা ভ্যাকসিন মানুষের জন্য নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এমনই দাবি করা হচ্ছে। এটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ খবর। আসলে এই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে করা পরীক্ষায় মানুষের মধ্যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে। করোনাভাইরাস তো দুর্বল উপর সরাসরি আক্রমণ করে। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের প্রতিকারের কথা বলা হচ্ছে। যেমন বারবার গরম জল খাওয়া এবং হলুদ দেওয়া দুধ খাওয়া। কিন্তু, প্রতিরোধ ক্ষমতা তো আর একদিনে বিকশিত হয় না। ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুর্দান্ত অর্জনের পর এই কথা বলতে ইচ্ছা করছে, বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখনই কোনও বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে তখনই সর্বাগ্রে আমেরিকা এগিয়ে এসে সেই সঙ্কট মোকাবিলা করেছে। আমেরিকাই বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু, এবার এই দৌড়ের কোথাও নেই আমেরিকা। যাইহোক এখন এই কথা বলার সময় নয়। এখন প্রধান লক্ষ্য হল করোনাভাইরাসকে পুরোপুরি নির্মূল করা।
তবে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে এক হাজারের বেশি বিজ্ঞানীকে শমিল করা হয়েছিল। জানা গিয়েছে যাঁদের শরীরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে, তাঁদের শরীরে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে রাশিয়াও দাবি করেছে, তাঁরাও কড়নাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং রাশিয়া থেকে করোনা-ভ্যাকসিন তৈরি করার খবর একইসঙ্গে পাওয়া গিয়েছে। রাশিয়ায় জানিয়েছেন, যাবতীয় পরীক্ষার পর তাঁদের তৈরি ভ্যাকসিন এখন ব্যাবহারের জন্য প্রস্তুত। রাশিয়া জানিয়েছে, রাশিয়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সহযোগিতায় তৈরি হওয়া কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা সফল হয়েছে। এই ভ্যাকসিন ব্যাবহারের জন্য প্রস্তুত। ২০২০ সালের মধ্যেই রাশিয়া দেশীয়ভাবে ৩ কোটি করোনা ভ্যাকসিন এবং বিদশের জন্য ১৭ কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে। রাশিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যাঁদের উপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁরা ভালো বোধ করছেন এবং করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকশিত হচ্ছে। তবে, তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা কবে থেকে শুরু করবে রাশিয়া অথবা ভ্যাকসিনের কবে থেকে ব্যাপকহারে তৈরি করবে, তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। এটা নিশ্চিত যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাশিয়ায় ভ্যাকসিন তৈরিতে সেই সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীদেরও কৃতিত্ব রয়েছে, যাঁরা মূলত সেই দেশের নাগরিক নন। এখন বিশ্বের প্রধান প্রধান পরীক্ষাগারে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বৈজ্ঞানিকরা কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই ভারতীয়রা রয়েছেন। ব্রিটেন সরকার এই ভ্যাকসিনের ১০ কোটি ডোজ অর্ডার করে দিয়েছে। অর্থাৎ এটা প্রমাণিত, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি করা ভ্যাকসিন করোনার উপর ভালোভাবেই কাজ করবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, করোনাকে বিনাশ করতে কার্যকর এই ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ফলাফল উৎসাহজনক।
আরও একটি সুখবর হল-আমাদের অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এইমস)-এ করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। এইমস-এ মোট ১০০ জনের উপর ভ্যাকসিনের প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষা করা হবে। দেশে তৈরি হওয়া প্রথম করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের নাম কোভাক্সিন। ট্রায়ালের দায়িত্ব ডা: সঞ্জয় রায়ের উপর। হায়দরাবাদের ভারত বায়োটেক ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি মিলিত প্রচেষ্টায় কোভাক্সিন তৈরি করেছে। ভ্যাকসিনের কোড নাম বিবিভি ১৫২। দেশের ১২টি স্থানের মধ্যে একটি হল এইমস দিল্লি যেখানে এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চলছে। এখানকার স্যাম্পেল সাইজ গোটা দেশের মধ্যে সবথেকে বড় তাই সামগ্রিক ফলাফল গবেষণার দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে। ইতিমধ্যেই এইমস পাটনা এবং রোহতক পিজিআই-তে এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চলছে। গোয়াতেও ট্রায়াল প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা ভ্যাকসিনের উৎপাদন প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির করোনা ভ্যাকসিন নভেম্বরের।মধ্যে ভারতে পৌঁছে যাবে। ভারতে এর মূল্য প্রায় এক হাজার টাকা হতে পারে। খুব বেশি দাম না তা তো বলাই যেতে পারে। সরকার হয়তো ভর্তুকি দিয়ে ভ্যাকসিনের দাম কমানোর প্রচেষ্টা করবে।
সবমিলিয়ে প্রধান বিষয় হল-করোনার বিরুদ্ধে জয়লাভের সময় এসে গিয়েছে। এই ভ্যাকসিন এখন মানুষের কাছে এসে গিয়েছে।সমগ্র বিশ্ব বিজ্ঞানীদের কাছে সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকবে। ভ্যাকসিন তৈরির জন্য দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁরা। এরই মধ্যে ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা করোনার টিকা তৈরি করার জন্য কাজ করে চলেছেন। আমার হয়তো আগামী দিনে আরও সুখবর শুনতে পারব। আসলে বিজ্ঞানীরা কোনও দেশ অথবা সমাজের নন। তাঁরা সকলের। আসলে তাঁরা বিশ্ব নাগরিক হিসেবে বিবেচিত। এখন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও রাশিয়ার উপলব্ধিতে সমগ্র বিশ্ব উপকৃত হবে। এবার তো বিজ্ঞানীদের জন্য কিছু করা উচিত। করোনা-প্রকোপের আগে শোনা যেত ক্ষেপণাস্ত্র অথবা বোমা দিয়ে বিশ্বকে পুরোপুরি ধ্বংস করা যেতে পারে। এই ধ্বংসলীলা থামানো উচিত। নতুন বিশ্ব তৈরির জন্য বিজ্ঞানীরা এখন সংকল্প নিয়েছেন।
(লেখক প্রবীণ সম্পাদক, কলামিস্ট এবং প্রাক্তন সাংসদ)