কলকাতা, ১৬ আগস্ট (হি.স.) : প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী |বৃহস্পতিবার আজ বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। খবরটা শোনার পর থেকেই মন ভারাক্রান্ত কলকাতার ঘনশ্যাম বেরিওয়ালের। কলকাতায় এলে বন্ধু ঘনশ্যাম বেরিওয়ালের ১৬৭ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে বাড়িতে উঠতেন বাজপেয়ী | আজ ঘনশ্যাম বেরিওয়ালের কথায় উঠে এল বাজপেয়ীর জীবনের অজানা বহু ঘটনা |
৮৮ বছরের ঘনশ্যাম বেরিওয়ালের সঙ্গে ১৯৫৬ সালে দিল্লিতে পরিচয় হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর । দু’জনেই তখন আরএসএস-এর সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আলাপ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। তারপর থেকে অটল বিহারী বাজপেয়ি কলকাতায় এলেই থাকতেন ১৬৭ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে। ঘনশ্যাম বেরিওয়ালের বাড়িতে। ৪২ বছরে তাঁর অনেকটা সময় কেটেছে সেন্ট্রাল কলকাতার এই বাড়িতে। বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে ঘনশ্যাম বেরিওয়াল বললেন, \”উনি আমাদের পরিবারের মতোই ছিলেন। কখনই এটা ভাবতে দিতেন না যে উনি আমাদের অতিথি।একদম বাড়ির সদস্যদের মতো থাকতেন৷ লুঙ্গি পরে ঘোরাঘুরি করতেন৷ ঠিক সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠতেন৷ একটু হাটাহাটির পর ঠিক সকাল ৯টায় বৈঠকখানায় চলে আসতেন৷ দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতেন৷ উনি যে ঘরে থাকতেন তার পাশেই ছিল রান্নাঘর৷ তাই সুযোগ পেলেই সটান রান্না ঘরে চলে যেতেন৷ রান্নায় বেশি করে মশলা, লাল লঙ্কার গুঁড়ো দিতে বলতেন৷ উনি একটু মশলাদার খাবার পছন্দ করতেন৷ আর মাছ খেতে ভালোবাসতেন৷ কিন্তু আমরা মাড়োওয়ারি৷ তাই উনাকে মাছ খাওয়াতে পারতাম না৷ তার জন্য উনি কখনও বাড়িতে আসা বন্ধ করেননি৷ আমরা যা খেতাম তাই খেতেন উনি৷ কোনও চাহিদা বা দাবি ছিল না৷’’
মাছ যেমন ভালোবাসতেন৷ তেমন তাঁর ফুচকাও ছিল ভীষণ প্রিয়৷ ঘনশ্যামবাবু জানালেন, বাড়ির বারান্দা থেকে হাঁক দিয়ে ফুচকাওয়ালাকে ডেকে আনতেন অটলজী৷ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতেন৷ চাট ছিল ভীষণ প্রিয়৷ কিন্তু যতই হোক ছিলেন তো তিনি অটল বিহারী বাজপেয়ী৷ তাই পরের বার থেকে ফুচকা ঘরে নিয়ে এসে তাঁকে দেওয়া হত৷ আর মাছ খাওয়ার জন্য ছুটে যেতেন এক বন্ধুর বাড়িতে৷ ঘনশ্যামবাবুকে যাওয়ার জন্য সাধতেন৷ কিন্তু বিনীতভাবে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতেন তিনি৷
যে খাটে বসেছিলেন সেই বিছানাটা দেখিয়ে বললেন, \”বিশ্রাম করার দরকার হলে এই খাটেই দু’জনে শুয়ে পরতাম। উনি এখানে শুয়ে গান গাইতেন।\” প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অবশ্য দু’জনের দেখা করাটা এত সহজ ছিল না নিরাপত্তার কারণে। তখন ঘনশ্যামজি রাজভবনে চলে যেতেন অটল বিহারী বাজপেয়ির সঙ্গে দেখা করতে। কখনও আবার তাঁদের দেখা হত এয়ারপোর্টে। একবার ঘনশ্যামজি রাজভবনে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে অটল বিহারী বাজপেয়ী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, \”তুমি দিল্লি গেলে দেখা করো না কেন?\” ঘনশ্যামজি বলেছিলেন, \”আপনার সঙ্গে দেখা করতে হলে ৩৬ জনকে উত্তর দিতে হয়।\” শুনে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠান সেক্রেটারিকে। বলেন, \”ও এলে ওকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না।\” ঘনশ্যামজির কথায়, অটলবিহারী বাজপেয়ী কখনই একজন রাজনৈতিক নেতার মতো বা প্রধানমন্ত্রীর মতো ব্যবহার করতেন না।\” বলেন, \”উনি আমাকে সবসময় ছোটো ভাইয়ের মতো দেখতেন। আমার থেকে চার বা পাঁচবছরের বড় ছিলেন। কিন্তু সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো।\”
সবরকমের আলোচনাই হত দু’জনের মধ্যে। কথায় কথায় একবার ঘনশ্যামজি বলেছিলেন, \”এই আমি বলে দিচ্ছি কোনও মুসলিম আপনাকে ভোট দেবে না।\” উত্তরে উনি বলেছিলেন, \”গদি আমাদের পেতে হবে। কিন্তু ওদের ভোট ছাড়া তো পাওয়া যাবে না। ওদের আপন ভেবে আমরা যদি খেয়াল রাখি তবে ওরা নিশ্চয় আমাদের ভোট দেবে।\”
১৯৯৬ সালে ফের কলকাতায় আসেন অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ ঘনশ্যামবাবুর সবে হার্ট সার্জারি হয়েছে৷ তাই বন্ধুকে দেখতে এসেছিলেন৷ তখন অটল বিহারী বাজপেয়ী দেশের প্রধানমন্ত্রী৷ তাঁর নিরাপত্তায় ঘনশ্যামবাবুর বাড়িকে দুর্গে পরিণত করে দেয় এসপিজি৷ সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে তাঁকে দেখতে আসেন অটল বিহারী বাজপেয়ী৷ বন্ধুকে দেখতে পেয়ে তাঁকে যথারীতি বাড়িতে থাকতে বলেন৷ হালকা মেজাজের সুরে তখন অটলজী বলেছিলেন, ‘‘আগের জমানা আলাদা৷ এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে৷ আমি এখানে থাকলে আপনার প্রতিবেশীরা গালি দেবে৷’’ শুনে দু’জনেই হেসে ফেলেন৷
বন্ধুর অসুস্থতার খবর পেয়ে যেমন অটল বিহারী বাজপেয়ী ছুটে এসেছিলেন৷ তেমনই অটল বিহারী বাজপেয়ীর অসুস্থতার খবর পেয়ে দিল্লি যান ঘনশ্যামবাবু৷ তখন স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী৷ কাউকে চিনতে পারতেন না৷ কিন্তু বন্ধুকে দেখা মাত্র তাঁকে চিনে ফেলেন অটল বিহারী৷ আবেগঘন গলায় ঘনশ্যামবাবু বললেন, ‘‘মুখ দেখা মাত্র আমার নাম মনে পড়ে যায়৷’’
ঘনশ্যামজি যেমন অটল বিহারীর কাছের মানুষ ছিলেন তেমনই তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন ঘনশ্যামজির ছেলে কমল বেরিওয়াল। অটল বিহারী বাজপেয়ি যখন তাঁদের বাড়িতে আসতেন, এক টেবিলে বসেই খাওয়াদাওয়া করতেন তাঁরা। ছোটোবেলায় তাঁর সঙ্গে লুডো, দাবাও খেলেছেন। নানারকম গল্প করতেন দু’জনে। কমল বেরিওয়ালের স্ত্রী প্রতিভা বেরিওয়াল বলেন, \”বাড়ির বউদের নিয়ে উনি সিনেমা দেখতেন। হলে গিয়ে দেখার সুযোগ হত না। বাড়িতে বসে টিভিতেই দেখতাম। হিন্দি ক্লাসিক সিনেমা অটলজির খুব প্রিয় ছিল। উমরাও জান এত পছন্দ হয়েছিল যে একদিনে টানা তিনবার দেখেছিলেন। দিল্লিতে ফেরার সময় উমরাও জানের সিডি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। একবার আমাদের নিয়ে হোটেলে খেতে যাবেন বলে ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন।\” এমন অনেক ঘটনা আজ মনে পড়ে যাচ্ছে প্রতিভাদেবীর। কমল বেরিওয়ালের সঙ্গে বিয়ের পর প্রতিভাদেবীকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী । নতুন বউ বাড়িতে এসেছে বলে নিজে হাতে চা, জলখাবার বানিয়ে খাইয়েছিলেন।
অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো একজন ব্যক্তিত্ব তাঁদের বাড়িতে এসে থাকতেন অথচ কেউ টেরই পেত না। মনে হত ঠিক যেন পরিবারেরই কেউ। এতটাই সাধারণ ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। বেরিওয়ালের এই বাড়িটা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন অটল বিহারী বাজপেয়ী । আজ তাঁর চলে যাওয়ায় বড় বেশি করে সেইসব পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে বেরিওয়াল পরিবারের।