নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৮ মার্চ৷৷ দেনার বোঝা সামলাতেই এখন হিমসিম খেতে হচ্ছে নতুন সরকারকে৷ বোঝার পরিমান ১১৩৫৫.৫৩ কোটি
টাকা৷ ঋণ এবং অন্যান্য দেনা মিলিয়ে বিগত সরকার নতুন সরকারের জন্য এই বোঝা রেখে গেছে৷ তাছাড়া, বছর বছর কোটি কোটি টাকা বিগত সরকারের আমলে খরচই হয়নি৷ আবার কখনো প্রাপ্ত অর্থের তুলনায় খরচের বহর ছিল অনেক বেশি৷ শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ সুনিশ্চিত না করেই বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করায়, অসম্পূর্ণ প্রকল্পগুলির কাজ শেষ করতে বকেয়া দায়ভার ১৬৪৪.৯০ কোটি টাকা৷ রবিবার অর্থমন্ত্রী তথা উপ-মুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা সাংবাদিক সম্মেলনে এসমস্ত বিষয় উল্লেখ করে রাজ্যের বর্তমান আর্থিক অবস্থা সম্পর্কিত শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন৷ সাথে জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার কঠিন আর্থিক সংকটের মুখোমুখি সত্বেও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনে বদ্ধপরিকর৷ তাঁর কথায়, বিগত সরকারের আর্থিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার কারণেই রাজ্যের এই অবস্থা হয়েছে৷ তাঁর দাবি, রাজ্যের আর্থিক অবস্থার হাল ফেরাতে ত্রিমুখী পরিকল্পনা মেনে চলবে বর্তমান সরকার৷
এদিন উপ-মুখ্যমন্ত্রী বলেন, গত ১৬ মার্চ রাজ্যের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে৷ তাতে, রাজ্যের আর্থিক অবস্থার ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে এসেছে৷ তাঁর মতে, রাজ্যের বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুবই সংকটজনক৷ এই অবস্থার জন্য তিনি বিগত সরকারকে দায়ী করেছেন৷ তাঁর কথায়, বিগত সরকারের আর্থিক বিশৃঙ্খলার জন্যই রাজ্যের এই অবস্থা হয়েছে৷ কোন পরিকল্পনা এবং অর্থের বন্দোবস্ত না করেই প্রকল্প চালু করে দিয়ে রাজ্যকে গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে৷
উপ-মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, বিগত কয়েক বছরে রাজ্যের ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ তবে, কোন কোন বছরে মোট প্রাপ্তির তুলনায় অর্থ অব্যয়িতও রয়েছে৷ উপ-মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট প্রাপ্তি ৭৮৮৭.৬৯ কোটি টাকা এবং মোট ব্যয় ৭০২৭.৪৯ কোটি টাকা৷ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট প্রাপ্তি ৮৭৫৭.২৯ কোটি এবং মোট ব্যয় ৭৮২৫.৩৭ কোটি টাকা৷ এই দুটি অর্থবছরে প্রাপ্ত অর্থ পুরোটা খরচই করতে পারেনি রাজ্য সরকার৷ কিন্তু, ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে প্রাপ্ত অর্থের তুলনায় ব্যয় ক্রমশ বেড়েছে৷ ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে মোট প্রাপ্তি ১০০৭৮.০১ কোটি টাকা এবং মোট ব্যয় ১০৫৯০.৯৩ কোটি টাকা৷ ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে মোট প্রাপ্তি ১০৮৮৭৭১ কোটি টাকা এবং মোট ব্যয় ১১৫২৫.৬২ কোটি টাকা৷ ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে মোট প্রাপ্তি ১১১৮১.৯৩ কোটি টাকা এবং মোট ব্যয় ১২৬৯১.৬১ কোটি টাকা৷
উপ-মুখ্যমন্ত্রী বলেন, নির্দিষ্ট প্রকল্পে কয়েকটি অর্থ বছরে কেন্দ্রের টাকা খরচই করতে পারেনি রাজ্য সরকার৷ ওই টাকা এখনো কোষাগারে পড়ে রয়েছে৷ নির্দিষ্ট প্রকল্পে বরাদ্দ হওয়ায় ওই টাকা অন্য খাতে খরচ করা যাচ্ছে না৷ তাঁর কথায়, ২০১১-১২ অর্থ বছরে ২৯৬২.৪১ কোটি টাকা পেয়েছিল রাজ্য সরকার৷ খরচ করতে পেরেছে মাত্র ১৪৯১.৭১ কোটি টাকা৷ অনুরূপ ২০১২-১৩ অর্থ বছরে রাজ্য পেয়েছিল ৩১২৭.৬২ কোটি টাকা, কিন্তু খরচ করতে পেরেছে মাত্র ১৪২৯.০৪ কোটি টাকা৷ তাতে স্পষ্ট, কেন্দ্রের দেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা খরচই করতে পারেনি বিগত সরকার৷ অথচ, তাঁরা কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে সদা সুর চরিয়েছে, কটাক্ষ করেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী৷
তাঁর মতে, পূর্বতন রাজ্য সরকার এই গভীর আর্থিক সঙ্কটের বিষয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারেনি এবং এই সংকটের চিত্র জনসমক্ষে উন্মোচিত করতে চায়নি৷ তাঁর কথায়, গত ৫ বছরে প্রকৃত অর্থপ্রাপ্তি ও ব্যয় সংশোধিত আনুমানিক ব্যয়ের তুলনায় কম ছিল৷ ফলে দেখা যাচ্ছে, পূর্বতন রাজ্য সরকার রিভাইজড এস্টিমেট তৈরির সময় আয় ও ব্যয়ের কোনও বাস্তবসম্মত এস্টিমেট তৈরি করেনি৷
রাজ্যের আর্থিক অবস্থার রিপোর্টে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে৷ তা সত্বেও রাজ্য বিগত চার বছর ধরে কোন সুফল পায়নি৷ উপ-মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, বিগত চার বছরে রাজ্যের নিজস্ব রাজস্ব বৃদ্ধির প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে৷ কিন্তু, ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে এই রাজস্ব বৃদ্ধির অনুপাত সঙ্গতিপূর্ণ নয়৷ তাঁর কথায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০৭৩.৯১ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১৭৪.২৬ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৩৩২.২৫ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৪২২.০১ কোটি টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত ১২৭৫.৩৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে৷ কিন্তু, ব্যয়ও এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে৷
এদিন উপ-মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পূর্বতন সরকার বাজেট বরাদ্দ ও খরচের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি, ফলে রাজস্ব ঘাটতি বেড়েই চলেছে৷ তাঁর কথায়, পূর্বতন সরকার ঋণ ও অন্যান্য দেনা বাবদ ১১৩৫৫.৫৩ কোটি টাকার বোঝা রেখে গেছে৷ সাথে এই বোঝার জন্য ন্যুনতম ৭.২ শতাংশ হারে সুদও দিতে হচ্ছে৷ ফলে, নতুন সরকারকে এই ঘাটতি স্থান থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে হচ্ছে৷
উপ-মুখ্যমন্ত্রী সাথে যোগ করেন, পূর্বতন রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ সুনিশ্চিত না করেই বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল৷ কোথা থেকে অর্থ মিলবে তা না জেনে পদক্ষেপ নেওয়ার খেসারত এখন বর্তমান সরকারকে দিতে হবে৷ তাঁর কথায়, এধরনের অসম্পূর্ণ প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ করতে বকেয়া দায়ভার ১৬৪৪.৯০ কোটি টাকা৷
অর্থনৈতিক অবস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাজেট ডকুমেন্ট অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্য সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৩৩১ জন এবং পেনশনার্স রয়েছেন ৫৬ হাজার ৪৪১ জন৷ কর্মচারীদের বিস্তারিত বিবরণ হল, বিভিন্ন দপ্তরে নিয়মিত রাজ্য সরকারি কর্মচারী ১ লক্ষ ১৬ হাজার ১১২ জন, স্বশাসিত কিংবা রাজ্য সরকার অধিগৃহীত সংস্থায় কর্মচারী ৮ হাজার ৩১০ জন এবং ফিক্সড পে, ডিআরডব্লিও, কন্টিজেন্ট মিলিয়ে ৩৬ হাজার ৯০৯ জন৷ রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪৩৯ শতাংশ হচ্ছে সরকারী কর্মচারী৷ নতুন সরকার সপ্তম বেতন কমিশন লাগু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে৷ ফলে, সপ্তম বেতন কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যবস্থা করাও প্রাধান্য পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে৷ উপ-মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, সপ্তম বেতন কমিশন লাগু করতে মহার্ঘ্য ভাতা সহ অন্যান্য ভাতা প্রদানের জন্য বছরে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে ১৪৫৯.৫১ কোটি টাকা৷
তবে, এদিন তিনি আশ্বস্ত করেন, নব নির্বাচিত রাজ্য সরকার এই কঠিন আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া সত্বেও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজ্যের জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে বদ্ধ পরিকর৷ উপ-মুখ্যমন্ত্রীর দাওয়াই, রাজ্যের অর্থনৈতিক হাল ফেরাতে ত্রিমুখী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷ তাঁর কথায়, রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি, সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যয় এবং ভারত সরকারের কাছ থেকে আর্থিক বরাদ্দ লাভের মাধ্যমে রাজ্য সরকার এই সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছে৷ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, ভারত সরকার নিশ্চই সাহায্য করবে৷ তিনি জানান, মুখ্যমন্ত্রী ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চাইতে রবিবারই দিল্লী গিয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সহ বিভিন্ন মন্ত্রকের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিদের সাথে তিনি দেখা করবেন৷ এদিকে, তাঁর দাবি, রাজস্ব বৃদ্ধির নীল লক্সা তৈরি করা হবে৷ কর সংগ্রহও সঠিকভাবে করা হবে৷ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, রাজ্যের জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতায় সরকার এই অর্থনৈতিক সংকটের সমাধানে দৃঢ় সংকল্পের সাথে মোকাবিলা করার পাশাপাশি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য কাজ করবে৷