রাজ্য সরকারের সমবায়ী বিপ্লব যে এইভাবে থমকাইয়া যাইবে তাহা হয়তো এতদিন ভাবা যায় নাই৷ এক সময়, প্রথম বাম সরকার রাজ্যের ক্ষমতায় অধিষ্টিত হইবার পরও দেখা গিয়াছে সমবায় আন্দোলনের উপর কী সারগর্ভ ভাষণ৷ যেন সমবায় আন্দোলনের সাফল্যই পাল্টাইয়া দিতে পারে মানুষের আর্থিক বুনিয়াদ৷ রাতারাতি সমবায় আন্দোলন তেজি হইয়া উঠিল৷ গ্রাম শহরে চালু হইয়া গেল সমবায়ী দোকান৷ ল্যাম্পস প্যাকস৷ রাজধানী শহর আগরতলায় গড়িয়া উঠিল ‘আইতরমা’ সমবায় বিপনী৷ সরকারী কেনা কাটা ওই সব সমবায় বিপনী হইতে কেনা বাধ্যতামূলক করা হইল৷ টেন্ডার ছাড়াই কোটি কোটি টাকার কেনাকাটা চলিল৷ রাজ্যে সমবায় দপ্তরের কলেবর বাড়িল৷ রাতারাতি গণহারে সমবায় সমিতি গড়িয়া উঠিল৷ কিন্তু দুর্নীতির থাবা সমস্ত শুভ উদ্যোগকে প্রায় তছনছ করিয়া দিল৷ অধিকাংশ সমবায় বিপনী, যেগুলি রাজ্য সরকারের তত্বাবধানে পরিচালিত হইত সেগুলির ঝাপ ধীরে ধীরে বন্ধ হইতে থাকে৷ প্যাকস, ল্যাম্পসগুলির নির্বাচিত কমিটির মাধ্যমে পরিচালনার কারণে রাজনীতির থাবাও সংকটকে আমন্ত্রণ জানায়৷ এইসব ল্যাম্পস ও প্যাকসের বহু কর্মীর ভাগ্যও এখন ঝুলিয়া রহিয়াছে৷ সমবায়ী বিপ্লবের নিদর্শন এখনও আছে, সেই সমবায়ী কর্মীদের চাকুরীর অনিশ্চিয়তা এবং কোনও বেতন কাঠামো না থাকায় যৎ সামান্য বেতনে কায়ক্লেশে জীবনধারণ৷
সমবায় আন্দোলনের সাফল্যের চাইতে যে ব্যর্থতাই অনেক জায়গা জুড়িয়া আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই৷ সমবায় আন্দোলনের অস্তিত্ব ধরিয়া রাখিয়াছে সমবায় ব্যাংক৷ রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই সমবায় ব্যাংক লাভের মুখ দেখিয়াছে৷ অন্তত অন্যান্য সমবায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো তলাইয়া যায় নাই৷ সোজা কথায় মরিতে মরিতে বাঁচিয়াছে৷ সমবায় ব্যাংকের পোষাকি নাম ত্রিপুরা স্টেট কো অপারেটিভ ব্যাংক৷ এই ব্যাংকের শাখা প্রশাখা সারা রাজ্যেই ছড়াইয়া ছিটাইয়া আছে, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সমানতালে আগাইতে পারিতেছে না৷ এখন সেই পুরনো ধ্যানধারণায় চলিতেছে ব্যাংক৷ বছর কয়েক হইল কম্পিউটার সংযোগ হইলেও সারা রাজ্য বা সারা দেশের ব্যাংকিং পরিষেবার সুযোগ দিতে পারিতেছে না৷ ফলে, গ্রাহকদের তেমন আকর্ষণ করিতে ব্যর্থ হইতেছে৷ রবিবার সকালে আগরতলা পোষ্ট অফিস চৌমুহনীতে এই ব্যাংকের নব নির্মিত ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ সেই অনুষ্ঠানে সমবায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ভাল পরিষেবা দিয়া গ্রাহকদের আকৃষ্ট করিতে পরামর্শ দিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তিনি বলিয়াছেন, ‘এখন প্রতিযোগিতার বাজার৷ এই বাজারে টিকিয়া থাকিতে গেলে ভাল পরিষেবা দিতে হইবে৷ পদস্থ আধিকারিক হইতে একেবারে নীচু স্তর পর্য্যন্ত সকলকে তাঁহাদের ব্যবহার, আচরণের উপর বিশেষ নজর দিতে হইবে৷’ কিন্তু বাস্তব অবস্থা কি৷ সরকারী সাহায্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে পাওয়া সত্বেও সমবায় ব্যাংক কাঙ্খিত লক্ষ্যে আগাইতে পারে নাই৷
ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয় এবং পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের ফল পাওয়া যায়৷ ত্রিপুরা গ্রামীণ ব্যাংক আজ স্বচ্ছলতার মুখ দেখিয়াছে৷ এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিয়াছেন৷ সরকারী দপ্তরগুলির কর্মচারীদের বেতন প্রদানের জন্য একাউন্ট খোলা, বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী অফিসগুলির আমানত জমা রাখা ইত্যাদি সহায়তা পাইয়া ত্রিপুরা গ্রামীণ ব্যাংক এখন স্বচ্ছলতার মুখ দেখিয়াছে৷ এক্ষেত্রে কর্মচারীদের কঠোর পরিশ্রমও সহায়ক হইয়াছে৷ কিন্তু, লক্ষ্যণীয় যে, ত্রিপুরা সমবায় ব্যাংক সেই ভাবে আগাইতে পারে নাই৷ দেশের বড় বড় রাজ্যের ব্যাংকগুলি জাতীয় ব্যাংকের মর্যাদা লাভ করিয়াছে৷ ত্রিপুরার সমবায় ব্যাংক সেই শ্রেণীর কাছাকাছি যাইতে না পারিলে দিনে দিনেই গ্রাহকদের আকর্ষণ কমিয়া যাইবে৷ রাজ্য সমবায় ব্যাংক নামে হইলেও সমবায়িক কাঠামো নাই বলিলেই চলে৷ রাজ্য সরকারই মূলত এই ব্যাংক পরিচালনায় রহিয়াছে৷ রাজ্যে সমবায় আন্দোলন এক সময় যে জোয়ার আনিয়াছিল কিংবা জনমন আন্দোলিত হইয়াছিল তাহারই একটি স্মরণ চিহ্ণ হিসাবে দাঁড়াইয়া আছে সমবায় ব্যাংক৷ এই ব্যাংকের প্রসারতা ও শ্রীবৃদ্ধিই ত্রিপুরায় সমবায় আন্দোলনের ইতিহাসকে ধরিয়া রাখা৷ নাই মামার চাইতে কানা মামাই ভাল- এই শান্ত্বনাই কি সমবায় ব্যাংকের পুরস্কার বা প্রাপ্তি৷
2016-02-09