গণতন্ত্র দিবস পালনের ক্ষেত্রে সাধারণ্যে তেমন উন্মাদনা এখন আর দেখা যায়৷ অথচ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৪৯ সালের পর এই ছাবিবশে জানুয়ারী দিনটি জনউন্মাদনায় পালিত হইত৷ এই দিনে নানা অনুষ্ঠানে জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল৷ কিন্তু ইহাই সত্যি যে, এখন সরকারী উদ্যোগে দিনটি পালিত হয়৷ বৃহত্তর গণতন্ত্রের দেশে, এমন একটি দিনে দেশবাসীর মনে সেই উন্মাদনা না থাকার পিছনে যেসব কারণ রহিয়াছে তাহার অন্যতমই হইতেছে গণতন্ত্রের উপর একশ্রেণীর লোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের কালো হাতের প্রসারণ৷ গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা এখন খুব বেশী প্রশ্ণ চিহ্ণের সামনে দাঁড় করাইয়াছে৷ সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীদের খপ্পরে পড়িয়া গণতন্ত্রের গৌরব ধুলায় লুটাইতেছে৷ একথা তো স্বীকার করিতেই হইবে যে, সারা দেশেই গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ ঘটিয়াছে৷ পঞ্চায়েত, নগর পঞ্চায়েত, পুর নিগম, পুরসভা, আরও অনেক স্বয়ংশাসিত সংস্থা পরিচালিত হয় গণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা৷ গণতন্ত্রের এই সম্প্রসারণ, জনগণের অংশগ্রহণে প্রশাসন পরিচালনায় নতুন প্রত্যাশা পূরণে কতখানি সহায়ক হইয়াছে, সেই প্রশ্ণ এখন বড় কথা৷ গণতন্ত্রের কল্যাণেই আজ জনপ্রতিনিধিত্বের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ১৯৪৯ সালে যে স্বাধীনতার সূর্য্যোদয় হইয়াছিল, তাহার হাত ধরিয়াই গণতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হইয়াছিল ছাবিবশে জানুয়ারী ১৯৪৭ সালে৷ এদিনই স্বাধীন সার্বভৌম ভারতবর্ষের সংবিধান গৃহীত হয়৷ সে সংবিধানই গণতান্ত্রিক দেশ পরিচালার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করিয়া চলিতেছে৷
দেশের সাধারণতন্ত্রের জয়যাত্রা আজ ৬৭ তম বছরে কতখানি সফল সে প্রশ্ণ উঠিতেই পারে৷ আজ নানা প্রশ্ণ উঠিয়া আসিয়াছে৷ গণতন্ত্রের এই সুফল সাধারণ গরীব অংশের মানুষের মধ্যে কতখানি পৌঁছিয়াছে? আজ ধনীক পঁুজিপতিদের হাতেই ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু৷ পঁুজিপতিদের খঁুশি করা, তাহাদের মদত দেওয়া, সরকারী সুযোগ সুবিধা প্রদান করার ঘটনা তো আছেই৷ এদেশের বিত্তবানরাই দেশনায়ক তৈরী করেন৷ তাহারা কাড়ি কাড়ি টাকা ছিটাইয়া নির্বাচনে বাজীমাৎ করে৷ টাকার কাছে আমাদের গণতন্ত্রের পুজারীরাও আত্মসমর্পণ করিয়াছে৷ জাতপাতের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক উস্কানী ইত্যাদির ঘটনার তো শেষ নাই৷ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আমাদের গণতন্ত্রের মহিমাকে ভুলুন্ঠিত করিয়াছে৷ একথা আজ বিনা দ্বিধায় প্রশ্ণ করা যায়, রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতারা এখন নিজেদের সৎ সাচ্চা বলিয়া কতখানি দাবী করিতে পারেন? দুর্নীতি, ভ্রষ্টাচার নেতাদের যখন গ্রাস করিয়াছে, তখন সততা ও স্বচ্ছতার গর্ব করিবার তো কোনও সুযোগ নাই৷ ভারতের গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোয় দুর্নীতি একেবারে সর্বত্র বিরাজিত৷ এই ভয়াল অবস্থা হইতে যে না সহসা মুক্তি নাই৷
সত্যি বলিতে কি, ভারতের সংবিধানই কার্য্যত সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট৷ জাতপাতের সংরক্ষণ সংবিধানকে স্বচ্ছতার প্রশ্ণের মুখে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে৷ জাতপাত ভিত্তিক সংরক্ষণের কারণে আমাদের ‘মহান’ সংবিধানই তো সাম্প্রদায়িকতা দোষে আচ্ছাদিত৷ যে দেশে জাতপাত ভিত্তিক সংরক্ষণ হয় সেই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধন কতখানি শক্ত হইতে পারে৷
লোকসভার অধ্যক্ষ সুমিত্রা মহাজন হক কথা বলিয়াছেন৷ রাজনৈতিক ব্যাপারীরা এখন চিৎকার জুড়িয়া দিয়াছেন৷ মহাজন শুধু ইতিহাসের তথ্যই তুলিয়া ধরিয়াছেন৷ সংবিধান রচয়িতা ডঃ বি আর আম্বেদকর মাত্র দশ বছরের জন্য নিম্মবর্গের মানুষের জন্য সংরক্ষণ রাখিয়াছিলেন৷ রাজনৈতিক নেতারাই নিজেদের স্বার্থে, ভোটের স্বার্থেই এই সংরক্ষণ অনাদিকাল যাবৎ চালাইয়া যাইতে চাহিতেছে৷ ইহা অন্যায়, গুরুতর অন্যায়৷ নিম্নবর্গের মানুষের জন্য দীর্ঘকাল সংরক্ষণ চালু রহিয়াছে৷ তাহাদের অনেকেই এখন অর্থ বিত্তে এমন কি শিক্ষায় অনেক বেশী অগ্রসর৷ এই অনগ্রসরদের জন্য সংরক্ষণ চালু থাকিবে কোন্ যুক্তিতে? অর্থনৈতিক দিক দিয়া পিছাইয়া পড়া মানুষকে চিহ্ণিত করিয়া তাহাদের জন্যই সংরক্ষণের সুবিধা দিতে পারিলেই সুবিচার করা হইবে৷ যাহারা মুখে জাতপাতের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হইতেছেন তাহারা কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে অনেক বেশী ভরসার৷ আর যেসব রাজনীতিকরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে, হিংসার প্ররোচনা দেন তাহাদের চিহ্ণিত করিয়া কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারিলে ভবিষ্যতে গভীরতর ক্ষতের সৃষ্টি করিবে৷ যে ক্ষত সহজে নিরাময় করা যাইবে না৷ আজ রাজনীতি তো সাধারণ মানুষের কাছে নাই৷ সেখানে তো এক শ্রেণীর মাফিয়া সমাজ বিরোধীরা অনুপ্রবেশ করিয়াছে৷ গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভই তো এখন মাফিয়াদের করতলগত৷ আজ স্বাধীন সংবাদপত্রের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ বাঁচিয়া থাকিবার চ্যালেঞ্জ৷ চরম দুর্ভাগ্যের এইখানেই যে, সংবাদ মাধ্যম আজ পথ হারাইয়াছে৷ দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রশ্ণের মুখে দাঁড়াইয়াছে৷ আজ সাধারণতন্ত্র দিবসের ঐতিহাসিক লগ্ণে গভীর প্রশ্ণ সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে উঠিয়া দেশ মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে? যদি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করা না যায় তাহা হইলে সমস্যা বাড়িবেই৷ ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে৷’ এই স্বপ্ণ তো প্রতিটি ভারতবাসীর৷ নতুন ভারত গড়িতে হইবে৷ কিন্তু দেখিয়া মনে হইতেছে, সততা ও স্বচ্ছতার মধ্যে যদি দেশ আগাইতে না পারে তাহা হইলে লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব৷
2016-01-26