
কলকাতা,১২ জুন (হি.স): সন্দেশখালি কাণ্ডের প্রতিবাদে বুধবার বিজেপির লালবাজার অভিযানকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের সংযোগস্থলে । অবরুদ্ধ হয়ে যায় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ । বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে, বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে জলকামান ও কাঁদানে গ্যাসের সেল ছোঁড়ে পুলিশ । গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা, সমর্থক । এরপরই দেড় ঘন্টার মধ্যে আন্দোলন তুলে নেওয়া হয় বিজেপির পক্ষ থেকে ।
যদিও রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আমরা পুলিশের সঙ্গে লড়তে আসিনি । পুলিশ আমাদের উপর অত্যাচার করছে’।লালবাজার অভিযান স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করে দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আজকের আন্দোলন শেষ হল । ৫০ জনের বেশি কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, পুলিশ জানিয়েছে সকলকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । তাই আজকের মতো আন্দোলন শেষ । গোটা ঘটনা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানানো হবে’।
সব মিলিয়ে মাত্র দেড় ঘণ্টা । দুপুর একটা থেকে বেলা আড়াইটে । এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেল বিজেপির লালবাজার অভিযান । যা দেখে অনেকেই বলছেন । যতটা গর্জন হয়েছিল, ততটা বর্ষণ হল না ।
তখনও মূল মিছিল শুরু হয়নি সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে । তিনজন বিজেপির মহিলা মোর্চার কর্মী হাতে দলীয় পতাকা নিয়ে আচমকা পৌঁছে যান লালবাজারের সদর দরজার সামনে । রাস্তায় বসে পড়ে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে শুরু করেন । সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করা হয় তাঁদের ।
একে একে সব নেতারা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের সামনে উপস্থিত হলে বেলা একটা কুড়ি নাগাদ মিছিল শুরু করে বিজেপি । দুপুর পৌনে দুটো নাগাদ লালবাজারে না গিয়েই শেষমেশ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে বসে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, দিলীপ ঘোষ, লকেট চট্টোপাধ্যায়রা । সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকেই মূলত এদিনের কর্মসূচিতে ইতি টানেন দিলীপ ঘোষরা । ততক্ষণে কাঁদানে গ্যাস ও জলকামানের দাপটে বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা,কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন ।
বিবি গাঙ্গুলী রোডের মুখে আসতেই বিজেপি-র মিছিল আটকে দেয় পুলিশ । একটি ব্যারিকেড ভাঙে বিজেপি কর্মীরা । তারপরই পুলিশ জল কামান চালাতে শুরু করে । ছোঁড়া হয় কাঁদানে গ্যাস । ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় জনতা । অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় । অসুস্থ হয়ে পড়েন বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও । কাঁদানে গ্যাসের জেরেই বিজেপি নেতা রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানা যায় । রাস্তাতেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন । পরে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । কাঁদানে গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আরও কয়েকজন বিজেপি কর্মী,সমর্থক । এ প্রসঙ্গে বিজেপি রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ দিলীপ ঘোষ ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘আমাদের মিছিলে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো হয়েছে । শান্তিপূর্ণ ভাবে মিছিল হচ্ছিল, কোনওরকম সতর্ক না করেই আমাদের সাংসদ, শীর্ষ নেতাদের উপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো হয়েছে’। এমনকি, কোনও অ্যাম্বুল্যান্স রাখা ছিল না বলে অভিযোগ করেছেন বিজেপি নেতারা । দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের অভিযোগ, ‘জঘন্য রাজনীতি চলছে বাংলায় । এখানে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে’ । তাঁর দাবি, বিনা প্ররোচনায় কাঁদানে গ্যাস ফাটিয়েছে পুলিশ ।
একই রাজ্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয়র দাবি, রাজ্যের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর । এভাবে চলতে থাকলে রাজ্যের বিষয়ে কেন্দ্র ভাববে। রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের ইঙ্গিত দিয়ে কৈলাশের মন্তব্য, ‘আমরা চাই পাঁচ বছর সরকার চলুক । কিন্তু এভাবে চললে কেন্দ্রকে ভাবতে হবে’ ।
গোটা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দুপুর সওয়া দুটো নাগাদ বিজেপির দখলে চলে যায় । ম্যাটাডোরে মাইক বেঁধে পুলিশ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে ভাষণ দিতে শুরু করেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়, দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহারা । ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন বিজেপি কর্মী সমর্থকরা । সেসময়ই জল কামান দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে পুলিশ, ফাটানো হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল । জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের শেল, এই জোড়া ফলাতেই মুহূর্তের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় বিজেপির মিছিল ।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ মোড়ে বিজেপির মিছিলে উত্তজেনা ছড়ায় । ইট ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে । বিজেপি পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় ছাদ থেকে তৃণমূল কর্মীরাই ইট ছুঁড়েছে । পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ । সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখান কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, এসএস আলুওয়ালিয়া, দিলীপ ঘোষ, লকেট চট্টোপাধ্যায়রা ।
দুপুর দুটো পঁয়ত্রিশ নাগাদ বিজেপি রাজ্য দফতরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রাজ্য সভাপতি তথা মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষ জানিয়ে দেন আজকের মতো আন্দোলন এখানেই স্থগিত । তাঁর দাবি, পুলিশ ঘোষণা করেছে, ৫০ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করে মুক্তি দেওয়া হল। তারপর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । নেতৃত্ব বসে পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরি করবে ।
ফলে, দেড় ঘন্টাতেই আন্দোলন শেষ । রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীদের বিরোধী আন্দোলনের মেজাজেও আমূল বদল এসে গিয়েছে । এই পশ্চিমবঙ্গেই অতীতে ৫৯ এবং ৬৬-র খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল । ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ আন্দোলনের ইতিহাসও বাংলার রাজনীতিতে জ্বলজ্বল করছে । নয়ের দশকে যুব কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একুশে জুলাইয়ের আন্দোলন এবং তাতে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন কর্মীর মৃত্যু, এসবই এখন অতীত । বিরোধী আন্দোলনের ধরন দেখে অনেকেই বলছেন, মানসিকতা বদলেছে বলেই আন্দোলনের স্টাইল বদলে গিয়েছে । এখনকার পশ্চিমবঙ্গে ঝুঁকির আন্দোলন নেই ।
গত শনিবার তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় সন্দেশখালি । এ ঘটনায় নিহত হন দুই বিজেপি কর্মী প্রদীপ মণ্ডল ও সুকান্ত মণ্ডল । হিংসার ঘটনায় নিহত হন আরেক তৃণমূল কর্মী কায়ুম মোল্লা । দেবদাস মণ্ডল সহ আরও কয়েকজন কর্মী এখনও নিখোঁজ বলে দাবি বিজেপির । এ ঘটনার প্রতিবাদে গত সোমবার বসিরহাট মহকুমা এলাকায় বনধ ডাকে বিজেপি । একইসঙ্গে সেদিন রাজ্যজুড়ে কালাদিবস পালন করে বিজেপি । সন্দেশখালির ঘটনায় এনআইএ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বিজেপি নেতা মুকুল রায় ।

