জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী৷ জন্মভূমির প্রতি মনের, আত্মার টান আছে বলিয়াই তাকে স্বর্গের চাহিয়া গরিমাময় বলিয়া কবি সাহিত্যিকরা অভিহিত করিয়াছেন৷ যুগ যুগ ধরিয়া মাতৃভূমির বন্দনা চলিতেছে৷ সেই মাতৃভূমিকেই যদি বিস্মৃতির অতলে নেওয়ার চেষ্টা চলে তাহা হইলে ইহাকে কী বলা হইবে? দেশের প্রকৃত ইতিহাস খঁুজিতে চেষ্টা তো হইয়াছে, তবু কি বিকৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয় নাই? প্রকাশিত সংবাদে বলা হইয়াছে, ত্রিপুরার নবম শ্রেণীর পাঠ্যসূচী হইতে ভারতের ইতিহাস বাদ দেওয়া হইয়াছে৷ পাঠ্যসূচীতে রুশ বিপ্লব, সমাজতন্ত্রের উদ্ভব, লেনিনের ভূমিকা স্থান পাইলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ ভারতের ইতিহাসকে ব্রাত্য রাখা হইয়াছে৷ প্রকাশিত সংবাদের প্রসঙ্গে দেশপ্রেমিক মাত্রেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিতে পারেন৷ শাসন ক্ষমতায় যাহারাই থাকেন তাহারাই নিজেদের ইতিহাস ছাড়া অন্যকিছুকে শ্রদ্ধা সম্মান ও স্বীকৃতি তেমন দিতে চাহেন না৷ কেন্দ্রে কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল রাজীব, ইন্দিরা, জওহরলালকে নিয়া মাতামাতি হইয়াছে৷ বিজেপি ক্ষমতায় আসায় হিন্দুত্ববাদের জন্য যাহারা লড়াই করিয়াছেন এমন নেতাদের সামনের সারীতে আনা হইল৷ কংগ্রেস সরকার যাহাদের প্রায় বর্জন করিয়াছিল বা তাঁহাদের অবদানকে মূল্য দেয় নাই বিজেপি ক্ষমতায় আসিয়াই সেই ইতিহাসকেই সামনে নিয়া আসিয়াছে৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ‘গীতা’কে জাতীয় গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করিয়াছে৷ পাঠ্যপুস্তকে রামায়ণ, মহাভারতের অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গেই বামপন্থীরা একেবারে প্রতিবাদে সোচ্চার হইয়াছেন৷ শিক্ষাকে গেরুয়াকরণ করিবার প্রয়াস বলিয়া তাহারা প্রতিবাদ মুখর হইয়াছেন৷ এই ভাবে ক্ষমতা দখলের পরই শিক্ষাকে, ইতিহাসকে রাজনীতির সুবিধা অনুযায়ী যদি ব্যবহার করা হয় তাহা হইবে চরম দূর্ভাগ্যের৷
রুশ বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, লেলিনের ইতিহাসও ছাত্রছাত্রীদের জানা বুঝার মধ্যে কোনও বিরোধ বা বিতর্ক থাকা উচিত নহে৷ কিন্তু মূল প্রশ্ণ হইল, মাতৃভূমিকে বিস্মৃত হইয়া বিদেশের ইতিহাসকে প্রাধান্য দেওয়ার কোন যুক্তি থাকিতে পারে না৷ আগে দেশকে জানিতে হইবে, আগে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বুঝিতে হইবে৷ জন্মভূমিকে দূরে সরাইয়া বিদেশ ভূমির ইতিহাস নিয়া মাতামাতির মধ্যে গৌরব নাই৷ মাতৃভূমির প্রকৃত ইতিহাস না জানিয়া বিদেশভূমির ইতিহাস জানিতে যাহাদের আগ্রহ অনেক বেশী তাহাদের স্বদেশ চেতনা কতখানি আছে সেই প্রশ্ণ উঠিবেই৷ তাই, নবম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়িবে না, নেতাজী সুভাষ, গান্ধীজী সম্পর্কে জানিতে পারিবে না? ইহা চরম দূর্ভাগ্যেরই শুধু নয়, দেশের প্রতি অবজ্ঞা অবহেলারই এক নগ্ণ ঘটনা হিসাবে চিহ্ণিত হইতে পারে৷ রাজ্যে নবম শ্রেণীর পাঠ্যসূচীতে যদি রাজনৈতিক সংকীর্ণতার আশ্রয় নেওয়া হয়, দেশের ইতিহাস অবহেলিত হয়, তাহা হইলে ইহাকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসাবে চিহ্ণিত হইতে পারে৷ আজকের ছাত্রছাত্রীরা এমনিতেই দেশের ইতিহাস পড়িবার সময় পায় না৷ ইঞ্জিনীয়ারিং, ডাক্তারী পড়াশোনায় ও মেধার লড়াইয়ে যেসব ছাত্রছাত্রীরা যুক্ত আছে, যাহারা কেরিয়ারের পিছনে অবিরত দৌঁড়াইতেছে তাহারা দেশ, পৃথিবীকে কতখানি জানিতে পারে? দেশ ও বিশ্বকে যে যত বেশী জানিবেন তিনি ততবেশী প্রাজ্ঞ বলিয়া ধরিয়া নেওয়া যাইতে পারে? রুশ বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, মার্কস, লেলিন সম্পর্কে পড়াশোনায় কোনও আপত্তি থাকিবার কথা নহে৷ কিন্তু, দেশকে, দেশের বরেণ্য নেতাদের ভুলিলে চলিবে না৷ দূর্ভাগ্যের হইলেও ইহাই বাস্তব আজকের প্রজন্ম নেতাজীকে জানে না, জানেনা ঋষি অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে৷ জানে না স্বাধীনতা সংগ্রামে যাহারা আত্ম বলিদান করিয়াছে তাহাদের নাম৷ জানে না দেশকে, মাতৃভূমিকে৷
এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাইয়া রাজনৈতিক দলগুলি যদি ক্ষমতাসীন হইয়া নিজেদের রাজনৈতিক অভিসন্ধিকেই কচিকাঁচাদের উপর চাপাইয়া দিতে সচেষ্ট হয় তাহা হইলে ইহাকে কী চরম দূর্ভাগ্যের বলা যাইবে না? দেশ মাতৃকার জন্য যাঁহারা শহীদ হইয়াছেন, যাঁহারা দেশের জন্য নিজেদের অকাতরে বিলাইয়া দিয়াছেন তাঁহাদের আত্মত্যাগের কাহিনী এই প্রজন্মকে আদর্শের প্রতি অবিচল হইবার প্রেরণা দিতে পারে৷ সুতরাং রাজনৈতিক চশমা পরিয়া শিক্ষাকে সেই পথে চালিত না করিয়া প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়িবার মন্ত্রেই দীক্ষিত করার মধ্যেই প্রকৃত দেশ নায়কদের দায়িত্ব পালিত হইবে৷ সংকীর্ণ রাজনীতির যাঁতাকলে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে দেশ ও দেশবাসীকে পড়িতে হইয়াছে? বহু ছাত্রছাত্রীর জীবন অকালে ঝরিয়াছে৷ বহু মেধাবী ছাত্রকে নির্মম ভাবে খুন করা হইয়াছে৷ রাজনীতির নির্মমতার ইতিহাস তো ভুলিবার নহে৷ ছাত্রযুবরাই প্রতিটি সংকটে সামনের সারিতে দাঁড়াইয়াছে৷ আমাদের চোখের সামনে, বাংলাদেশ কিভাবে স্বাধীন হইয়াছে, সেই ইতিহাস তো ভুলিবার নহে৷ তাহার প্রকৃত ইতিহাসও তো বিকৃত করা হইয়াছে৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃতই যাহাদের অবদান আছে তাহাদের বিস্মৃতির অতলে তলাইয়া দেওয়া হইয়াছে৷ সম্মাননা প্রদানের তালিকায় তাহাদের নাম নাই৷ যাহাদের মুক্তিযুদ্ধে ন্যুনতম অবদান নাই বরং নিশ্চুপ থাকিয়াছে, বিরোধীতা করিয়াছে তাহারাই নির্লজ্জের মতো সম্মাননা গ্রহণ করিয়াছেন৷ যুগে যুগে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা হইয়াছে৷ সত্যিকারের ইতিহাস পাঠের সুযোগ হইতে বঞ্চিত করার প্রয়াসই চলিতেছে৷ আর সেই চক্রান্তের মূলে রহিয়াছে রাজনৈতিক ইতিহাসকে কচিকাঁচাদের মগজে নিবদ্ধ করা৷ কিংবা বলা যায় মগজ ধোলাই করা৷
2016-01-09