দারং, ১৪ সেপ্টেম্বর: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রবিবার আসামের দারং জেলায় এক বৃহৎ জনসভায় অংশগ্রহণ করে অপারেশন সিন্দুর-এর সাফল্যকে মা কামাখ্যা ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদের ফল বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “মা কামাখ্যার কৃপায় অপারেশন সিন্দুর একটি ঐতিহাসিক সাফল্য হয়েছে। আজ এই পবিত্র ভূমিতে এসে এক ভিন্ন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে।” প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফর জন্মাষ্টমীর উৎসবের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় তিনি তাৎপর্যপূর্ণ এক ঐক্যবদ্ধতা টানেন জাতীয় নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ নীতির সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের। তিনি স্মরণ করান স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে তাঁর ঘোষণা করা “সুদর্শন চক্র মিশন”-এর কথা, যার মাধ্যমে ২০৩৫ সালের মধ্যে ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করে তোলা হবে। এই মিশনের মূল লক্ষ্য একটি দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত, ইজরায়েলের ‘আয়রন ডোম’-এর মতো প্রতিরক্ষা কবচ তৈরি করা, যা কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী হামলা প্রতিরোধই করবে না, প্রয়োজনে পাল্টা জবাবও দেবে।
এই সফরে প্রধানমন্ত্রী ৬,৩০০ কোটিরও বেশি মূল্যের একাধিক স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামো প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস করেন। এর মধ্যে রয়েছে দারং মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, নার্সিং কলেজ ও জিএনএম স্কুল, যার সম্মিলিত ব্যয় প্রায় ৫৭০ কোটি। একই সঙ্গে ১,২০০ কোটির কুরুয়া-নারেঙ্গি সেতু এবং ৪,৫৩০ কোটির গুৱাহাটী রিং রোড প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এছাড়াও গলাঘাট জেলায় ৫,০০০ কোটির বাঁশ-ভিত্তিক ইথানল প্ল্যান্ট ও ৭,২৩০ কোটির নিউমালিগড় রিফাইনারিতে পেট্রো ফ্লুইডাইজড ক্যাটালিটিক ক্র্যাকার ইউনিটেরও উদ্বোধন করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় পিছিয়ে পড়া আসাম আজ দেশের অন্যতম দ্রুত বিকাশমান রাজ্যে পরিণত হয়েছে, যার বার্ষিক আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এই অগ্রগতির জন্য তিনি রাজ্যের মানুষের দৃঢ় সংকল্প ও মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বাধীন “ডাবল ইঞ্জিন” সরকারকে কৃতিত্ব দেন।
ভূপেন হাজরিকার শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়ে বলেন, “আমি শিবভক্ত, আমার প্রতি যতই অপমান আসুক, আমি সহ্য করতে পারি, কিন্তু ভূপেন দাকে অপমান করলে তা মেনে নেওয়া যায় না।” তিনি অভিযোগ করেন, কংগ্রেস সভাপতি ২০১৯ সালে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে একজন গায়ককে ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছে, অথচ শিবকুমার স্বামীকে দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, “সংগীতপ্রেমী ও সংস্কৃতিপ্রেমীরা কংগ্রেসকে প্রশ্ন করুন কেন তাঁরা ভূপেন দাকে অপমান করলেন?” তিনি জানান, আসামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্মান জানানো ও সংরক্ষণ করা বিজেপি সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারগুলির একটি।
এদিনের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আরও একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে মুখ খোলেন—সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জনসংখ্যার গঠনে পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র। তিনি জানান, “দেশের সীমান্ত জেলাগুলিতে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।” এই প্রেক্ষিতে “ডেমোগ্রাফি মিশন”-এর সূচনা হয়েছে, যার মাধ্যমে সীমান্তবর্তী এলাকায় বেআইনি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও যাচাই প্রক্রিয়া চালু করা হবে। তিনি বিরোধীদের আক্রমণ করে বলেন, “আপনারা বলুন, অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আপনারা কী করেছেন? যারা তাদের আশ্রয় দেয়, তাদের দেশ ক্ষমা করবে না।” প্রশাসনিক আধিকারিকরা জানান, নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার হবে এবং রাজনৈতিক জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা হবে।
এই সফরের সূচনাতেই, শনিবার গুৱাহাটীতে একটি রোড শো-র মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আসামের জনমানসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে কটাক্ষ করে বলেন, “১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পরে উত্তর-পূর্ববাসীকে যা বলা হয়েছিল, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।” প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, “যখন আমরা স্বাধীনতার ১০০ বছর উদযাপন করব, তখন ভারত হবে ‘বিকসিত ভারত’।”
এই সফরের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেবলমাত্র আসামের উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরলেন না, বরং আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বার্তাও দিয়ে গেলেন যা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা, অনুপ্রবেশ ইস্যু ও জাতীয়তাবাদকে সামনে এনে বিজেপির অবস্থানকে আরও জোরদার করবে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।

