আলাস্কা বৈঠক ব্যর্থ, চুক্তি বা যুদ্ধবিরতি নেই: ট্রাম্প-পুতিন সম্মেলনের ফলাফলে ভারতের সামনে জটিল কূটনৈতিক সমীকরণ

কলকাতা, ১৬ আগস্ট : বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলাস্কার শীর্ষ বৈঠককে। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এবং গ্লোবাল জ্বালানি বাজারের দিশা—সব কিছুর ওপরই এই বৈঠকের প্রভাব পড়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে কোনও চুক্তি, ঘোষণা বা যুদ্ধবিরতির সম্মতি আসেনি। ট্রাম্পের আলোচনার জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পুতিন কার্যত কিছু না দিয়ে আলোচনার মঞ্চে নিজের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

এই ব্যর্থ বৈঠক ইউরোপ এবং ইউক্রেনের নেতাদের জন্য সাময়িক স্বস্তি হলেও ভারতের জন্য এটি তৈরি করেছে এক জটিল এবং বহুস্তরীয় কূটনৈতিক পরিস্থিতি। দিল্লি এই বৈঠকের দিকে নজর রেখেছিল প্রধানত আমেরিকার আরোপিত ২৫ শতাংশ ‘সেকেন্ডারি ট্যারিফ’ বা অতিরিক্ত শুল্কের কারণে। সেই শুল্ক ভারতের জন্য যেমন অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করছে, তেমনি কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ।

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার আগে ভারতের অপরিশোধিত তেলের আমদানির তালিকায় মস্কোর অংশীদারিত্ব ছিল মাত্র ২ শতাংশের নিচে। তবে পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ান তেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর, রাশিয়া ভারতকে বড় ছাড়ে তেল দিতে শুরু করে। এর ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাশিয়া হয়ে ওঠে ভারতের বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ, যেখানে বর্তমানে প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আসে রাশিয়া থেকে।

এই পরিবর্তন শুরুতে আমেরিকাও উৎসাহ দিয়েছিল, বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসনের সময়, যাতে বিশ্ব বাজারে তেলের সরবরাহ স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় আসার পর এই পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্য, রাশিয়ান তেল কেনার মাধ্যমে ভারত পরোক্ষভাবে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে মস্কোকে সাহায্য করছে, এবং এই চাপ বাড়াতেই ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়েছে।

আলাস্কা বৈঠকের আগের দিন ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “রাশিয়া তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল গ্রাহককে হারিয়েছে (ভারতকে), এবং তারা সম্ভবত প্রথম বৃহত্তম গ্রাহককেও হারাবে। এটাই পুতিনকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে।”

ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী, ভারতকে ট্যারিফের চাপে ফেলেই রাশিয়ার অর্থনৈতিক শিরদাঁড়া ভাঙার চেষ্টা চলছে, এবং সেটাই কূটনৈতিক আলোচনার পথ তৈরি করেছে। তবে ভারত এই বক্তব্যকে “অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন” বলে নাকচ করেছে। নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, ভারত শুধু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক লাভের ভিত্তিতে তেল আমদানি করে, এবং যে তেল কোনও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না, তা আমদানিতে ভারতের কোনও বাধা নেই।

দুই পরাশক্তির মধ্যকার সংঘাত ভারতকে এক অস্বস্তিকর অবস্থানে ফেলেছে। একদিকে রাশিয়া ভারতের বহু পুরনো কৌশলগত সহযোগী, অন্যদিকে আমেরিকা এখন ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত অংশীদার। এই দুয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে ভারতকে প্রতিনিয়ত বিচক্ষণ কূটনীতির আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

বর্তমানে আমেরিকার অভিযোগ যে, ভারত রাশিয়ার তেল কিনে মস্কোকে পরোক্ষভাবে আর্থিকভাবে সহায়তা করছে। ট্রাম্প প্রশাসন এটিকে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা ভারতের ওপর একই ধরনের শুল্ক আরোপ করে।

তিনি স্পষ্ট বলেন, “আমরা ভারতের ওপর সেকেন্ডারি ট্যারিফ আরোপ করেছি, এবং যদি পুতিন-ট্রাম্প বৈঠকে অগ্রগতি না হয়, তবে সেই শুল্ক আরও বাড়ানো হতে পারে।”

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনা নির্ভর করে বাজারের মূল্য এবং লভ্যতার ওপর। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পরও সরকার কোনও নির্দেশ দেয়নি রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধ করতে। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলোর শীর্ষ কর্তারাও জানিয়েছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে আমদানি কমার একমাত্র কারণ হল—ছাড় কমে যাওয়া, মার্কিন চাপ নয়।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা আমাদের নীতির অগ্রাধিকার। আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়, সেখান থেকেই আমদানি চলবে। তেল কিনব, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনও দেশের নির্দেশে নয়।”

আলাস্কার ব্যর্থ বৈঠক এখন এক নতুন দোলাচলে ফেলেছে নয়াদিল্লিকে। যদি ভবিষ্যতে ট্রাম্প আবারও ভারতের ওপর চাপ বাড়ান, তবে কৌশলগত অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। একইসঙ্গে ভারতের দিক থেকে পরিষ্কার—ওয়াশিংটনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও, স্বার্থের প্রশ্নে ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়।

একদিকে মার্কিন প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা সহায়তা, অন্যদিকে সস্তায় জ্বালানি—এই দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রাখা ভারতের কাছে এখন সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। আগামী সপ্তাহগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত এবং ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার অবস্থানের ওপর নির্ভর করবে ভারতের পরবর্তী পদক্ষেপ।