ওয়াশিংটন, ১৫ জুলাই: যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে বড়সড় পরিবর্তন আনল ট্রাম্প প্রশাসন। নতুন এক প্রশাসনিক নীতিমালায় বলা হয়েছে, যারা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন এবং বর্তমানে অভিবাসন আদালতে নিজেকে বহিষ্কারের (ডিপোর্টেশন) বিরুদ্ধে লড়ছেন, তারা আর জামিন শুনানির আবেদন করতে পারবেন না। এই পদক্ষেপের ফলে দেশের অভ্যন্তরে থাকা লাখ লাখ অনিবন্ধিত অভিবাসীকে দীর্ঘ সময় ধরে আটক রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট -এর অ্যাক্টিং ডিরেক্টর টড এম. লায়ন্স ৮ জুলাই একটি মেমো জারি করেন, যেখানে বলা হয়, অবৈধ অভিবাসীদের “বহিষ্কারের কার্যক্রম চলাকালীন পুরো সময়টা” আটক রাখা হবে। পূর্ববর্তী প্রশাসন, বিশেষ করে বাইডেন সরকারের সময়, যেখানে অভিবাসীরা জামিন শুনানির মাধ্যমে আদালতের সামনে নিজেকে মুক্ত রাখার সুযোগ পেতেন, সেখানে নতুন এই নির্দেশিকা সেই অধিকার পুরোপুরি বাতিল করেছে।
মেমো অনুযায়ী, আইসিই কর্তৃপক্ষ তাদের আইনজীবীদের নির্দেশ দিয়েছে যেন তারা অভিবাসন আদালতে জামিনের বিরোধিতা করে এবং “বিকল্প যুক্তি” তুলে ধরে অব্যাহত বন্দিত্বের পক্ষে অবস্থান নেন। মেমোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই নীতিগত পরিবর্তন “আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে” এবং এটি “বর্তমান আইনি ব্যাখ্যার সম্পূর্ণ বিপরীত” হতে পারে।
এই পরিবর্তনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে থাকা এবং বাইডেন প্রশাসনের সময় প্রবেশ করা বহু অনথিভুক্ত অভিবাসী প্রভাবিত হবেন। হোয়াইট হাউজের বক্তব্য অনুযায়ী, এই নীতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ, যেখানে তিনি প্রথম বছরে ১০ লক্ষ অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়নের কথা বলেছেন। এরই মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ৫৬,০০০ অভিবাসী আইসিই-এর হেফাজতে রয়েছেন এবং নতুন নীতির ফলে এই সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়বে বলে অনুমান।
নতুন এই নীতির ফলে বহু অভিবাসী দীর্ঘদিন ধরে আটক অবস্থায় থাকতে বাধ্য হবেন, এমনকি যাঁরা আশ্রয়ের আবেদন করেছেন এবং বিচার প্রক্রিয়া চলমান, তাঁরাও। অভিবাসন অধিকার কর্মীরা এবং আইনি বিশেষজ্ঞরা এই নীতিকে “মানবাধিকারের পরিপন্থী” ও “সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন” হিসেবে দেখছেন।
সুপরিচিত অভিবাসন আইন বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্মকর্তা টম জাওয়েটজ বলেন, “এটি একটি মৌলিক পরিবর্তন। কয়েক দশক ধরে চলে আসা আইনি রীতিনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এর ফলে বন্দি জনসংখ্যা হঠাৎ করে কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে।”
সর্বোচ্চ উদ্বেগের বিষয় হলো, এই বন্দিরা দেশের দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত কেন্দ্রে আটক থাকবেন। যেমন ফ্লোরিডার berাধুনিক নিরাপত্তা-সংবলিত ‘অ্যালিগেটর আলকাট্রাজ’ বা অ্যারিজোনার মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত কেন্দ্রে। এতে করে তারা আইনজীবীর সহায়তা পাওয়া, আদালতে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করা বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবেন।
আমেরিকান ইমিগ্রেশন লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই নিউ ইয়র্ক, ভার্জিনিয়া, ওরেগন, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহাইও ও জর্জিয়ার মতো অঙ্গরাজ্যে অন্তত এক ডজন অভিবাসন কোর্টে অভিবাসীদের জামিন শুনানির আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আদালতগুলি বিচার বিভাগের আওতায় পরিচালিত হয়, এবং এই ধরনের প্রশাসনিক নির্দেশে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
আইসিই এবং ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এই নীতি পরিবর্তন নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা গেছে, এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীঘ্রই একাধিক মামলা হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, অভিবাসীদের আটক রেখে বিচারের মুখোমুখি করা হলে, তাদের বহিষ্কারের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে। এই নীতির অন্যতম প্রবক্তা ও ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ থিংক ট্যাংক ‘সেন্টার ফর ইমিগ্রেশন স্টাডিজ’-এর নির্বাহী পরিচালক মার্ক ক্রিকোরিয়ান বলেন, “যদি আটক রেখে বিচার করা যায়, তাহলে আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন ব্যক্তিদের দ্রুত ফেরত পাঠানো সহজ হয়। খরচ বেশি, কিন্তু কার্যকর।”
এই নীতির বাস্তবায়ন যদি পূর্ণ মাত্রায় হয়, তাহলে তা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থাকে নয়, মানবাধিকার, বিচার ও সামাজিক কাঠামোকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একদিকে অভিবাসন আটক কেন্দ্রগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি বন্দিত্বে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা, উভয়ই আগামী দিনে বড় আইনি ও সামাজিক বিতর্ক তৈরি করতে পারে।
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠন ও অভিবাসী সহায়তাকারী সংস্থাগুলি ইতোমধ্যে প্রতিবাদ শুরু করেছে। তারা বলছে, ন্যায্য বিচার ছাড়া এত বড় সংখ্যক মানুষকে বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা শুধুমাত্র অমানবিক নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী। এখন দেখার বিষয়, আদালত ও কংগ্রেস এই নীতির বিরুদ্ধে কী অবস্থান নেয়।

