ঐতিহাসিক সফর ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

নয়াদিল্লি, ৫ জুলাই : ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সদ্যসমাপ্ত সরকারি সফর ভারত ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের এই গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপদেশটির মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২৬ বছরের ব্যবধানে এই প্রথম কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দেশটিতে দ্বিপাক্ষিক সফরে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই সফর শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, কৃষি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির মতো বহুমাত্রিক খাতে কার্যকর সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

এই সফরের তাৎপর্য কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক। ১৮৪৫ সালের ৩০ মে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে প্রথম ভারতীয় অভিবাসীদের আগমন ঘটেছিল। সেই ঘটনাকে স্মরণ করে এবারের সফর অনুষ্ঠিত হয়, যা দুই দেশের মধ্যে প্রায় দুই শতাব্দীর প্রাচীন প্রবাসী ভারতীয়দের ঐতিহ্য ও অবদানের প্রতীক। এই উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদী ভারতীয় প্রবাসীদের ছয় প্রজন্ম পর্যন্ত ওসিআই কার্ড প্রদানের ঘোষণা দেন।

ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রধানমন্ত্রী কমলা প্রসাদ-বিসেসারের আমন্ত্রণে ৩ ও ৪ জুলাই সফর করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সফরকালে তাঁকে দেশটির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘অর্ডার অফ দ্য রিপাবলিক অফ ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো’ প্রদান করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ত্রিনিদাদ ও টোবাগো সফরকে ঘিরে দুই দেশের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভিত্তি রচনা করবে। ডিজিটাল সেক্টরে সহযোগিতার আওতায়, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোকে ভারতের ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস ভিত্তিক ডিজিটাল অর্থপ্রদানের প্ল্যাটফর্ম গ্রহণকারী প্রথম ক্যারিবিয়ান দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ডিজিলকার, ই-সাইন এবং গভর্নমেন্ট ই-মার্কেটপ্লেস (জিইএম)-এর মতো ভারতীয় ডিজিটাল পরিষেবা প্ল্যাটফর্মে যৌথ সহযোগিতার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

স্বাস্থ্যখাতে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ত্রিনিদাদে ৮০০ জনের জন্য কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি, দেশটিকে ২০টি হেমোডায়ালিসিস ইউনিট ও ২টি সামুদ্রিক অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহ করা হবে। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা খাতে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও গভীর হবে। কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর কৃষি উন্নয়ন সংস্থা নামদেভকো-কে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কৃষিযন্ত্রপাতি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে, এবং ভারত প্রাকৃতিক কৃষি, সামুদ্রিক শৈবাল সার ও মিলেট (বাজরা) চাষে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করবে।

শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে সহযোগিতার অংশ হিসেবে, ভারত ত্রিনিদাদ সরকারকে ২০০০টি ল্যাপটপ উপহার দেয়। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী মোদী ত্রিনিদাদীয় ছাত্রদের আইটিইসি ও আইসিসিআর স্কলারশিপের মাধ্যমে ভারতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ গ্রহণে উৎসাহিত করেন, যা যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।

সফরের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল সাংস্কৃতিক ও প্রবাসী সংযোগকে পুনর্জীবিত করা। প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘গীতা মহোৎসব’ উপলক্ষে ত্রিনিদাদ থেকে পণ্ডিতদের ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানান এবং এই অনুষ্ঠান উভয় দেশে পালনের প্রস্তাব দেন। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মহাত্মা গান্ধী সাংস্কৃতিক সহযোগিতা কেন্দ্রের কার্যক্রম নবায়ন করে ২০২৫-২০২৮ সালের জন্য সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি চালু করা হয়। ভারত স্টিল প্যান, পারফর্মিং আর্টস, হিন্দি শিক্ষা ও যোগচর্চার প্রশিক্ষক পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর জাতীয় শিক্ষাক্রমে যোগা অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনাকেও ভারত পূর্ণ সমর্থন জানায়।

ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়। মোদী ঘোষণা করেন, ভারত যুব মহিলা ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণের জন্য দরজা খুলে দেবে। এই লক্ষ্যে একটি ক্রীড়াভিত্তিক এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, প্রতিভা উন্নয়ন, অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং যৌথ উদ্যোগে ক্রীড়াক্ষেত্রে উন্নয়নের দিকগুলো নিশ্চিত করা হবে।

আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রসঙ্গে, সফরের সময় ত্রিনিদাদ ও টোবাগো ভারতের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভে পূর্ণ সমর্থনের ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি, উভয় দেশ একে অপরের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ অস্থায়ী সদস্যপদ প্রার্থিতাকে যথাক্রমে ২০২৭-২৮ এবং ২০২৮-২৯ সালের জন্য সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে যৌথ পদক্ষেপে ঐকমত্য হয়, যা বৈশ্বিক দক্ষিণের স্বার্থ রক্ষায় দুই দেশের অভিন্ন অবস্থানকে আরও জোরদার করবে।

এই সব সমঝোতা ও উদ্যোগ মিলিয়ে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফর ভারত ও ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন যুগের সূচনা করে গেল।

দুই দেশের বাণিজ্য সহযোগিতা সংস্থাগুলির মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের আহ্বান জানানো হয়। উভয় নেতা জানান, নতুন বাণিজ্য-সহযোগিতামূলক কাঠামো নির্মাণ দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করবে।

ভারত আইটিইসি প্রোগ্রামের আওতায় ত্রিনিদাদ সরকারকে প্রতি বছর ৮৫টি প্রশিক্ষণ সুযোগ দিচ্ছে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দল স্থানীয় প্রশিক্ষণেও অংশ নিতে পারে বলে প্রধানমন্ত্রী মোদী জানান। ত্রিনিদাদ সরকার ফরেনসিক বিজ্ঞান ও বিচারিক ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের সহায়তা চাইলে মোদী সম্মতি দেন।

সফরের শেষে প্রধানমন্ত্রী মোদী ত্রিনিদাদ সরকার এবং দেশবাসীর উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী বিসেসারকেও তিনি ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান। উভয় পক্ষই একমত হন যে, এই সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক নতুন, শক্তিশালী এবং ভবিষ্যতমুখী অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

ত্রিনিদাদ ও টোবাগো সফর ছিল শুধুই প্রতীকী নয়— বরং এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে দুই প্রাচীন বন্ধুর মাঝে কৌশলগত ভবিষ্যতের রূপরেখা। ভারতের নেতৃত্বে বৈশ্বিক দক্ষিণের অগ্রগতির সঙ্গেই এই সফরের মাধুর্য জড়িয়ে থাকবে, আর এই দ্বীপদেশটির আকাশে ছড়িয়ে পড়বে ‘নতুন ভারতের’ সৌর আলো।
________

Leave a Reply