আগরতলা, ২৬ ফেব্রুয়ারি: “এক দেশ এক নির্বাচন” হলে কালো টাকা খরচ করে নির্বাচনে যেসব রাজনৈতিক দল লড়াই করে সেটি বন্ধ হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর হিসাববিহীন তহবিল প্রসমিত হবে। বাড়বে জিডিপি, এমনকি নির্বাচন খাতে খরচও কমবে সরকারের। এই প্রক্রিয়ায় অর্থনীতি ও গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেক সুদৃঢ় হবে। আজ আগরতলা রবীন্দ্র ভবনে অনুষ্ঠিত “এক দেশ এক নির্বাচন” শীর্ষক আলোচনা সভায় এমনটাই বললেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রফেসর ডঃ মানিক সাহা।
“এক দেশ এক নির্বাচন” নীতি আনতে চাইছে সরকার। ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় এই বিল পেশ করেন। এই এক দেশ একই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের জনগণের মনোভাব এবং তাদের চিন্তাধারা জানতেই এই সম্পর্কিত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজকের এই আলোচনা সভায় উপস্থিত থেকে মুখ্যমন্ত্রী “এক দেশ এক নির্বাচন” এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এক দেশ একই নির্বাচন” হলে প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দেখা যায় নির্বাচনে প্রচুর আর্থিক খরচ হচ্ছে। এছাড়াও শিক্ষক বা বিভিন্ন সরকারি কর্মচারীদের নির্বাচনে ডিউটি পড়ে। যার ফলে প্রায় প্রতি বছরের একটা সময় তাদের নির্বাচনের কাজে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। যার ফলে কর্ম ক্ষেত্রে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ক্ষতি হয় কর্মচারীদের, অপচয় হয় সময়।
এছাড়াও ” মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট”কে মাথায় রেখে বিভিন্ন কাজ করতে হয় নির্বাচনের সময়। বিভিন্ন ফাইলে স্বাক্ষরের কাজ আটকে থাকে বিভিন্ন দপ্তরে। ফাইলের পর ফাইল জমা হতে থাকে। মডেল কোড অফ কন্ডাক্টকে মান্যতা দিতে গিয়ে বিভিন্ন ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ততে ব্যাঘাত ঘটে। পিছিয়ে থাকে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবে এক দেশ এক নির্বাচন হলে এই সমস্যা সমাধান হবে বলে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি আরো বলেন, এক দেশ এক নির্বাচনের ফলে দেশের গণতন্ত্র মজবুত হবে। ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে। যুব সমাজের বেশিরভাগ ভোটার পড়াশোনার কারণে অথবা চাকরির সুবাদে রাজ্যের বাইরে থাকেন। ফলে যদি পাঁচ বছরে একবার নির্বাচন হয় তাহলে তারা উৎসাহের সঙ্গে সেই নির্বাচনে যোগদান করবেন। ফলে ভোটের শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু কিছুদিন পর পর স্থানীয় নির্বাচন, বিধানসভা নির্বাচন, এবং লোকসভা নির্বাচন একটির পর একটি অনুষ্ঠিত হতে থাকলে সেখানে সাধারণ জনগণ উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন না। যার ফলে ভোটের শতাংশেও অনেকটাই প্রভাব পড়ে।
আর্থিক খরচের কথা বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ২০১৯ সালের নির্বাচনে খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এক দেশ এক নির্বাচন হলে এই খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। ফলে বাড়বে জিডিপি।
তিনি আরো বলেন, কথায় কথায় নির্বাচন আসলে মনে হয় যে আবার নির্বাচন! প্রতি বছরই কোন না নির্বাচনের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নির্বাচন যখনই হয় তখন বিভিন্ন স্কুলের মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া হয়। এতে স্কুল বন্ধ থাকছে। সেক্ষেত্রে এক দেশ, এক নির্বাচন’ ভাবনা সঠিক হতে পারে। এতে ৫ বছরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়টা অন্তত স্বস্তি। প্রতি বছর বছর নির্বাচন হলে বিভিন্ন সমস্যা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এনিয়ে বার বার চেষ্টা করছেন। ২০১৯-এ তিনি এবিষয়ে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এবার ২০২৪-এ তিনি এবিষয়টি সংসদে নিয়ে আসেন। এরআগে কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির রিপোর্টও (১৮,০০০ পৃষ্ঠা) জমা পড়েছে। কত পরিশ্রম করে কতকিছু চিন্তাভাবনা করে সেই রিপোর্ট তৈরি করে পাঠানো হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ প্রক্রিয়ায় দুই পর্যায়ে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন। আর ৩ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে লোক্যাল বডির নির্বাচন হবে। আমি এই প্রক্রিয়াকে সত্যিকার অর্থে সমর্থন করি। এতে দেশের গণতন্ত্র অনেক শক্তিশালী ও মজবুত হবে এবং ভোটারদের মধ্যেও অনেক উৎসাহ বাড়বে। আর্থিক ক্ষেত্রেও অনেক লাগাম টানা যাবে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৯৮৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির ম্যানিফেস্টোতে ৫ বছর অন্তর অন্তর এক দেশ এক নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার ও বামেদের চাপে এই প্রক্রিয়া সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায় নি। কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি যা ভাবেন সেটাই করেন। ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কস্ট এফিসিয়েন্সি, গভর্নেন্স এন্ড স্ট্যাবিলিটি, ফেডারেল স্ট্রাকচার এন্ড কো অর্ডিনেশন, ভোটার টার্ন আউট এন্ড এনগেজমেন্ট এবং ইকোনমিক বেনিফিট অনেক শক্তিশালী হবে। আর এটাই আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ সাহা বলেন, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে যে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়া হয়েছিল তাতে সদস্য হিসেবে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, গুলাম নবি আজাদ, হরিশ সালভে সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ। আর ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। আমরা দেখেছি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এধরণের ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ হয়। যেমন ব্রাজিল, সুইডেন, বেলজিয়াম, সাউথ আফ্রিকা, জার্মানি, জাপান, ইউএসএ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স সহ বিভিন্ন দেশে এক দেশ এক ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে কেন হবে না?
যারা আর্থিক সমৃদ্ধি চান আমি আশা করি তারা ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ এর স্বপক্ষে তাদের মত প্রদান করবেন অভিমত ব্যক্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নিয়ে একটি বিল লোকসভায় পেশ করে। ২৬৯ জন এই বিলের পক্ষে ভোট দেন। আর বিপক্ষে ভোট দেন ১৯৮ জন। “এক দেশ এক নির্বাচন” নীতি চালু হলে সকল স্তরের জনগণ উপকৃত হবেন। তাই এর উপকারিতা বিবেচনা করে প্রত্যেকে এর সমর্থনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডঃ মানিক সাহা।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ তথা ভারতীয় জনতা পার্টির প্রদেশ সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্য, ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সব্যসাচী দাশগুপ্ত, অল ত্রিপুরা মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রতন সাহা, ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ ত্রিপুরা প্রদেশ কনভেনর ড. জহর লাল সাহা সহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ।

