দুর্গাপুর, ২৯ অক্টোবর (হি.স.): “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সব বিষয়ে রাজনীতি করাটা অভ্যাস। ব্যারেজের পলি সংস্কার, দেশের জন্য মানবতার জন্য বিষয়টি দেখা উচিত। তাই সব বিষয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়।” রাজ্যে বন্য পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্য – সংঘাত যখন চরমে তখন মঙ্গলবার পরিদর্শনে এসে দুর্গাপুর ব্যারেজ পলি সংস্কার নিয়ে রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে এভাবেই খোঁচা দিলেন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী ডঃ রাজ ভূষন চৌধুরী। উল্লেখ্য, মঙ্গলবার সারা দেশে রোজগার মেলার ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এদিন সারা দেশের সঙ্গে দুর্গাপুরেও এনআইটি অডিটোরিয়ামে ছিল রোজগার মেলার ভারচুয়ালি উদ্বোধন অনুষ্ঠান। ভারতীয় ডাকবিভাগ থেকে দুর্গাপুরের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সারা দেশে ৫১ হাজার যুবক যুবতীর হাতে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হয়। দুর্গাপুরে ১৮০ জন যুবক যুবতীর হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হয়। এদিন দুর্গাপুরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী ডঃ রাজ ভূষণ চৌধুরী। এছাড়াও ছিলেন বিধায়ক লক্ষন ঘড়ুই। সেখান থেকে দুর্গাপুর ব্যারেজ পরিদর্শনে যান মন্ত্রী। প্রসঙ্গত,পলি জমে নাবত্যা কমেছে দুর্গাপুর ব্যারেজের। কমছে জলধারন ক্ষমতা। ভারি বর্ষা হলেও জল ছাড়তে হয়। আর তাতেই দামোদর নিম্ন আববাহিকায় বন্যা দেখা দেয়। সঙ্কটে পর্যাপ্ত জল অমিল। আবার অতিবৃষ্টিতে জল ছাড়ায় বন্যা পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে রাজ্যের সাঁড়াশি আক্রমনের মুখে পড়ে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন(ডিভিসি)। গত কয়েকমাস ধরে রাজ্যে দফায় দফায় নিম্নচাপের দরুন প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। তার দরুন পশ্চিমবঙ্গে দামোদর উপত্যকায় জারি হয় লাল সতর্কতা। মাসখানেক আগে ঝাড়খন্ডে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়া মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার থেকে আড়াই লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হয়। ওই জল দুর্গাপুর ব্যারেজে ঢুকতেই দামোদর আববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। দুর্গাপুর ব্যারেজে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়তে হয়। ওই জলে দামোদর নিম্ন আববাহিকা বাঁকুড়ার মানাচর, হাওড়া, হুগলি জেলায় বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। আর এই প্লাবনে কার্যত ডিভিসির দিকে ‘ম্যানমেড’ বন্যার তকমা লাগিয়ে অভিযোগের আঙ্গুল তোলে রাজ্য সরকার। এমনকি ডিভিসির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যগের কথাও ঘোষনা করে। ডিভিসিতে রাজ্যে নিযুক্ত দুই আধিকারিকও পদত্যাগ করেন। কার্যত ডিভিসির সঙ্গে রাজ্যোর সংঘাত চরমে ওঠে। যা নিয়ে রাজ্যনৈতিক মহলে জোর চর্চা শুরু হয়। দামোদর উপত্যকা ঝাড়খন্ড ও পশ্চিম বর্ধমানে বৃষ্টিপাত হলে প্রভাব পড়ে দুর্গাপুর ব্যারেজের ওপর। জলস্তর বৃদ্ধি পায় ব্যারেজের। স্বাভাবিকভাবেই ওই জল ধরে রাখার বিকল্প কোনও ব্যাবস্থা নেই দুর্গাপুর ব্যারেজের। পলি পড়ে নাবত্যা কমেছে ব্যারেজের। প্রতিবছরই নিম্ন দামোদরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। অথচ, ব্যারেজের পলি সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের। যার মাশুল গুনতে হয় রাজ্যবাসীকে। উল্লেখ্য, ১৯৫৫ সালে দামোদর নদের ওপর দুর্গাপুর ব্যারেজটি তৈরি। উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের প্রসার ও বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলী, হাওড়া জেলার কৃষিকাজে সেচের সুবিধার জন্য মোট ৩৪ টি লকগেট। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে সংস্কার না হওয়ায় বর্তমানে পলি পড়ে নাবত্যা কমেছে দুর্গাপুর ব্যারেজের। ব্যারেজে ৫ হাজার একর ফুট জলধারন ক্ষমতা। কিন্তু নাবত্যা কমে বর্তমানে জলধারন ক্ষমতা ৫২ শতাংশ কমেছে। আর সেটাই অশনি সঙ্কেত দুর্গাপুরসহ তৎসংলগ্ন শিল্পাঞ্চল ও শস্যগোলা পূর্ব বর্ধমান জেলার। ব্যারেজের পলি সংস্কারের জন্য একাধিকবার লোকসভার স্ট্যান্ডিং কমিটি (নদী বিষয়ক) পরিদর্শনে এসেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ৯০ দশকে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে দামোদরের পলি সংস্কার ধরা হয়েছিল। এমনকি তাতে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। তার জন্য ক্রেন ও বার্জও আনা হয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা মাঝ পথে ফিরে যায়। ২০০৮ সালে ডিভিসি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছিল। তাতে ড্রেজিং হওয়া পলি বালি রাখার জমির জন্য আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের(এডিডিএ) কাছে আবেদন করেছিল। ওইসমস্ত পলি, বালি ইসিএলের পরিত্যাক্ত খনি ভরাটের জন্য চিন্তাভাবনা নেওয়া হয়েছিল। সেটাও মাঝ পথে থমকে যায়। যত দিন যায়, ততই সঙ্কটে পড়ে দামোদর। একদিকে যেমন দামোদর উপকূলবর্তী এলাকায় বর্ষায় বৃষ্টিপাত কমতে থাকে। তেমনই জমতে থাকে পলি। আর অন্যদিকে পলি সংস্কার নিয়ে শুরু হয় কেন্দ্র- রাজ্য চাপান উতোর। মাঝপথে দুর্ভোগে পড়ে রাজ্যের কৃষকরা। গত ২০১৭ সালে ৩০ মে দুর্গাপুরে এসে রাজ্যের উদাসীনতার দিকে আঙ্গুল তুলে ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় জল সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী উমা ভারতী। জোরাল প্রশ্ন ওঠে রাজ্য সরকারের ভুমিকায়। কারন, দুর্গাপুর ব্যারেজের দেখভালের দায়িত্ব রাজ্য সেচ দফতরে। সভ্যাতার অগ্রগতির সঙ্গে ব্যারেজের আধুনিকিকরনের প্রয়োজন হয়ে ওঠে। তবে বর্ষায় ব্যারেজ থেকে জল ছাড়া ও নিম্ন দামোদর উপকূলবর্তী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া নিয়ে একই প্রশ্ন ওঠে। সেটা হল ব্যারেজের পলি সংস্কার। সম্প্রতি জানা গেছে, ব্যারেজের উপরিভাগ ও নিম্ন দামোদরের মাঝ নদীতে বালুচর সংস্কারের উদ্যোগ নেয় রাজ্য মাইনস এন্ড মিনারেলস ডেভেলাপমেন্ট অথারিটি। ইতিমধ্যে দামোদরে সার্ভেও হয়েছে। তার জন্য পুনেতে মডেল স্টাডি করেছে রাজ্য মাইনস এন্ড মিনারেলস ডেভেলাপমেন্ট অথারিটি। দামোদরের মাঝ নদীতে চর জমে দ্বীপ তৈরি হয়েছে। সেখানে গজিয়ে উঠেছে গাছপালা। আবার কিছু জায়গায় নদীর চর দখল করে চলছে অবাধে চাষবাস। এক কথায় আস্ত দামোদর জবরদখল। ফলে দামোদরের গতি পথ যেমন বদলে গেছে তেমনই নাবত্যা কমছে দুর্গাপুর ব্যারেজের। আবার দেশের ১২ টি মহানদীকে ‘নির্মল ধারা, স্বচ্ছ কিনারা’ প্রকল্পে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও জলশক্তি মন্ত্রক। ওই প্রকল্পে দামোদরকে আওতায় আনার আর্জি রাখে শিল্পশহরবাসী। গতবছর দুর্গাপুরের সিআরপিএফ ক্যাম্পে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় বন, আবহাওয়া ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে। ওইদিন এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে ব্যারেজের পলি সংস্কার নিয়ে আশার বানী শুনিয়েছিলেন। দুর্গাপুর ব্যারেজের পলি সংস্কার ও দামোদর নদকে ‘নির্মল ধারা স্বচ্ছ কিনারা’ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির কথাও বলেন মন্ত্রী। কিন্তু এপর্যন্ত রাজ্য ও কেন্দ্রের চাপানউতোরে ব্যারেজের পলি সংস্কার কার্যত বিশ বাঁও জলে। মঙ্গলবার দুর্গাপুর ব্যারেজ পলি সংস্কার প্রসঙ্গে বর্তমান কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী ডঃ রাজ ভূষণ চৌধুরী বলেন,” ব্যারেজের জলধারন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিষয়টি মন্ত্রালয়ের কমিটিতে আলোচনা করা হবে। বিশেষজ্ঞ দল পাঠানো হবে। তাদের রিপোর্ট মোতাবেক কাজ হবে। রাজ্যের সঙ্গেও আলোচনা করা হবে।” তিনি আরও বলেন,” পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সব বিষয়ে রাজনীতি করাটা অভ্যাস। ব্যারেজের পলি সংস্কার, দেশের জন্য মানবতার জন্য বিষয়টি দেখা উচিত। তাই সব বিষয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়।”