২০২৬ সাল পৰ্যন্ত বন্ধ হবে বাল্যবিবাহ, সমাপ্ত হবে কাজিদের কাজ : মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্বগুয়াহাটি, ২৯ আগস্ট (হি.স.) : অসম বিধানসভায় ধ্বনিভোটে পাস হয়ে গেছে ‘আসাম রিপিলিং অর্ডিন্যান্স ২০২৪’ বিল। আজ বৃহস্পতিবার রাজ্য বিধানসভায় ধ্বনীভোটে বিলটি পাস হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আগামী ২০২৬ সাল পৰ্যন্ত বন্ধ হবে বাল্যবিবাহ, সমাপ্ত হবে কাজিদের কাজ।
গত ২২ আগস্ট রাজ্য বিধানসভার শরৎকালীন অধিবেশনের প্ৰথম দিন রাজ্যের রাজস্ব ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দফতরের মন্ত্রী যোগেন মোহন ‘আসাম মুসলিম ম্যারেজ অ্যান্ড ডিভোর্স রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৯৩৫’ (আসাম মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন) বাতিল করে ‘আসাম রিপিলিং অর্ডিন্যান্স, ২০২৪’ পেশ করেছিলেন।
প্ৰচলিত মুসলিম বিবাহ এবং তলাক প্রথা বাতিল সংক্রান্ত বিলের ওপর বক্তৃতা পেশ করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেছেন, এই বিলের উদ্দেশ্য হলো বাল্যবিবাহ এবং কাজি প্রথা বাতিল করা, মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধনকে সরকারি ব্যবস্থার আওতায় আনা। তিনি বলেন, আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে রাজ্যে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা হবে। তবে রাজ্যের বাইরে বাল্যবিবাহ হতে পারে, কিন্তু অসমে বাল্যবিবাহ হবে না।
তিনি আরও বলেছেন, সমস্ত বিবাহ অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুসারে নিবন্ধিত হতে হবে এবং অসম কাজিদের মতো একটি ব্যক্তিগত সংস্থাকে সমর্থন করতে পারে না।বিল বিতৰ্কে অংশগ্ৰহণ করে বিধায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, অনেক আরবি পণ্ডিত ও সরকারি শিক্ষক কাজি হিসেবে কাজ করছেন। গুয়াহাটির কেন্দ্রীয় কাজিও একজন শিক্ষক। ফলে কাজি একজন সরকারি ব্যক্তি। তিনি বলেন, অসমে খুব বেশি কাজি নেই। রাজ্যে কাজির সংখ্যা মাত্র ৯০।
রফিকুল ইসলামের বক্তব্যের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী ড. শৰ্মা বলেন, ‘৯০ জন কাজি নিয়ে চিন্তা করবেন না। মুসলিম মেয়েরা কী করে ন্যায় পায় তা নিয়ে ভাবুন। রফিকুল ইসলাম তাঁর দুই মেয়ের ন্যায়ের ব্যাপারে না ভেবে কাজিদের কথা ভাবছেন! চিন্তা করবেন না, আমি কাজিদের দেখভাল করব। কাজিদের কাজকৰ্ম বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই প্ৰচলিত আইনটি বাতিল করা হয়েছে।’
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে আসতে যদি অসুবিধা হয়, তা-হলে আমরা একটি পৃথক মুসলিম সাব-রেজিস্ট্রার অফিস তৈরি করব। যেখানে বিবাহ নিবন্ধন করা যাবে। কিন্তু মুসলিম বিবাহ ও তালাক শুধুমাত্র সরকারি অফিসেই নিবন্ধিত হবে। মুসলিম বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের জন্য ফি প্রতীকীভাবে এক (১) টাকা নেওয়া হবে। বেশি টাকা নেওয়া উচিত নয়। অর্থ উপার্জন করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।’
বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্তবিশ্ব আরও বলেন, ‘যেখানে দেশের সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যা, সেই জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারি অফিসগুলিতে মুসলিম বিবাহ নিবন্ধিত হয়৷ এমন-কি কেরালায়ও সরকারি দফতরে মুসলিম বিবাহ নিবন্ধিত হয়। আমরা কাজিদের এতদিনের কাজের জন্য ধন্যবাদ জানাব। ১০৩৫ সাল থেকে কাজিরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এখন তাঁদের আর এভাবে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়।’
বিধায়ক করিমউদ্দিন বড়ভুইয়াঁ বলেন, ‘কেবল মুসলিমরাই বহুবিবাহ করেন না, বহুবিবাহ উপজাতি সমাজ এবং চা বাগান এলাকায়ও ঘটে।’
করিমউদ্দিনের এই বক্তব্যের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের কথা বলে উপজাতি ও চা বাগানের মানুষের ক্ষোভ বাড়াবেন না। উপজাতি সমাজ এবং চা বাগান এলাকায় বহুবিবাহের প্রচলন নেই। নারীকল্যাণ ও ন্যায়বিচারের কথা ভাবুন। নারী মানে আমার মেয়েরা।’
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, মুসলিম বিবাহ ও তালাক প্রথার বাস্তুবিকতা সম্পর্কে ২২ আগস্ট বিল পেশ করে মন্ত্রী যোগেন মোহন বলেছিলেন, ‘প্রচলিত প্রথায় ২১ বছরের নীচে (পুরুষের ক্ষেত্রে) এবং ১৮ বছরের (মহিলার ক্ষেত্রে) ইচ্ছাকৃত ব্যক্তির বিবাহ নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে। রাজ্য জুড়ে নতুন আইন প্রয়োগের ওপর নজরদারি করার জন্য খুব কম বিধান ছিল। এটি আদালতে বিপুল সংখ্যক মামলা পড়েছিল। এছাড়া, বিবাহ এবং তালাক (বিবাহবিচ্ছেদ)-এর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক ছিল না। নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি অনানুষ্ঠানিক ছিল যা নিয়ম না মেনে চলার অনেক সুযোগ রেখেছিল, বলেছিলেন মন্ত্রী।
মন্ত্রী যোগেন মোহন বলেছিলেনন, ‘এটি একটি প্রাক-স্বাধীনতা আইন যা মুসলিম ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থার জন্য তৎকালীন অসম প্রদেশের জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল।’
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি অসম বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের শেষ দিন ‘আসাম মুসলিম ম্যারেজ অ্যান্ড ডিভোর্স রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৯৩৫’ (আসাম মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন) বাতিল করতে মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের আপত্তি করে সরকারকে চেপে ধরে এর নিন্দা করেছিলেন অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)-এর বিধায়করা।
এআইইউডিএফ-বিধায়কদের আপত্তিকে নস্যাৎ করে, একপ্ৰকার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মুখ্যমন্ত্ৰী হিমন্তবিশ্ব শৰ্মা বলেছিলেন, ‘যতদিন আমি বেঁচে থাকব, অসমে বাল্যবিবাহ চলতে দেব না, এই ব্যবসা বন্ধ করবই। এই ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। এটা সামাজিক কুফল। তা বন্ধ করতে সরকারের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগকে স্বাগত জানানো উচিত মুসলিমদেরও।’
সেদিন অধ্যক্ষকে উদ্দেশ্য করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘১৯৩৫ সালের মুসলিম ম্যারেজ অ্যাক্টে ভয়ংকর একটি অনুচ্ছেদ আছে, তাতে পাঁচ থেকে ছয় বছরের ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে মুসলমানদেরও ভাবতে হবে, তাঁদের ছেলেমেয়েদের শৈশবে বিয়ে দেওয়ার পরিণতি কী হতে পারে। একবার বাচ্চাদের কথা ভাবুন। তবে এটা ঠিক, আমি ৫-৬ বছর বয়সি মেয়েদের বিয়ে করতে দেব না।’ তিনি বিদ্যমান এই আইনের কযেকটি কুফল সম্পর্কেও তথ্য তুলে ধরেছিলেন বিধানসভায়।