অবিভক্ত ভারতের শ্রীহট্ট (সিলেট)-এ ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, মৌলভিবাজারের প্রথম নাট্যকার, লোক-সাধক, কবি, হাজারো দেহতত্ত্ব গানের রচয়িতা ও সুরকার, বৈষ্ণবসিদ্ধ তথা ধৰ্ম-প্ৰচারক, প্রবাদপ্রতীম সাধক, সমাজ সংস্কারক, অলৌকিক গুণসম্পন্ন রমণীমোহনকে হাজারো অনুসারীর শ্রদ্ধাঞ্জলি
।। সমীপকুমার দাস ।।
গুয়াহাটি, ২৫ ফেব্রুয়ারি (হি.স.) : আগামীকাল সোমবার বাংলাদেশের মৌলভিবাজার জেলার অন্তর্গত শ্রীপাট ঢেউপাশায় উদযাপিত হবে বৈষ্ণবসিদ্ধ প্রভু রমণীমোহন গোস্বামীর ৯৮-তম তিরোধান তিথি। সাড়ম্বরে তিরোধান তিথি উদযাপন করতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন আয়োজকরা।
এদিকে প্রভুপাদের ৯৮-তম তিরোধান তিথি উদযাপন করতে ভারতে অবস্থানকারী তাঁর লক্ষাধিক গৃহস্থ অনুসারীগণ তাঁদের স্ব-স্ব গৃহে এবং বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত আখড়া-আশ্রমে ইতিমধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন বলে জানা গেছে।
বৃহত্তর সিলেটর মৌলভিবাজার জেলার অন্তর্গত চাঁদনিঘাটস্থ ঢেউপাশায় সাধক রঘুনাথের সমাধিমন্দির এবং প্রভু শ্রীশ্রী শ্রীল রমণীমোহন গোস্বামীর আশ্রমের প্রধান সেবাইত ও পরিচালক রূপককান্তি গোস্বামীর সঙ্গে টেলিফোনে এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি জানান, আগামীকাল ১৩ ফাল্গুন, ২৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার, প্রভু রমণীমোহনের ৯৮-তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে আশ্রমে দু-দিনব্যাপী কীর্তন ও স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আশ্রমে প্রভুর বহু অনুসারী এসে গেছেন। আজ শুভ অধিবাসের মাধ্যমে শুরু হবে রমণীমোহন গোস্বামীর ৯৮-তম তিরোধান তিথি উপলক্ষ্যে আয়োজিত মহোৎসব।
প্রভুকে সশ্ৰদ্ধ প্রণাম জানিয়ে তাঁর অসংখ্য শিষ্য ও অনুসরণকারীদের স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধা আর গভীর আন্তরিক ভালোবাসা বিচ্ছুরিত করে রমণীমোহন গোস্বামী সম্পৰ্কে নরেন্দ্রনাথ গুপ্ত রচিত ‘শ্রীহট্ট প্রতিভা’র উদ্ধৃতি দিয়ে প্রথমেই প্রভুর পৌত্র রূপককান্তি গোস্বামী জানান, রমণীমোহন গোস্বামী একাধারে ছিলেন অবিভক্ত ভারতের শ্রীহট্ট (সিলেট)-এ ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, ব্রিটিশ আমলে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, মৌলভিবাজার জেলার প্রথম নাট্যকার, লোক-সাধক, কবি, হাজারো দেহতত্ত্ব গানের রচয়িতা ও সুরকার, বৈষ্ণবসিদ্ধ তথা ধৰ্ম-প্ৰচারক, প্রবাদপ্রতীম সাধক, সমাজ সংস্কারক, অলৌকিক গুণসম্পন্ন ছিলেন।
ব্ৰিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকে তিনি এতদঞ্চলের একজন প্রথমসারির বিপ্লবী সংগঠকের ভূমিকা পালন করে স্বাধীনতা-সেনানিদের দিগনির্দেশনা প্রদান করতেন। তাঁর দিগনির্দেশনায় নিবেদিতপ্রাণ সাহসী যুবকরা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তেন।
নরেন্দ্রনাথ গুপ্তচৌধুরী তাঁর রচিত দুটি গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট প্রতিভা’ এবং ‘চিন্ময় শ্রীহট্ট’-এ লিখেছেন, ‘‘মহাত্মা গান্ধী যখন থেকে অস্পৃশ্যতা-বিরোধী ও নিম্ন জাতির পক্ষে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম শুরু করেন তারও বহু আগে রমনীমোহন গোস্বামী ঢেউপাশায় অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে তিনি বৈশ্য ও শূদ্র সমাজে দীক্ষা দিয়ে শ্রীমন্ মহাপ্রভুর বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারে অগ্রণী ভূমিকার ইতিহাস স্থাপন করেন। রমণীমোহন তাঁর ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্র শিষ্যদের এক পঙক্তিতে বসে নাম কীর্তন ও প্রসাদ ভোজনের রেওয়াজ গড়ে তুলেন। এতে বৃহত্তর সিলেটে দারুণ সমালোচনার মুখে পড়েন রমণীমোহন। পরে অবশ্য সমাজের বিরাট একটি অংশ তাঁর এই মতবাদকে গ্রহণ করতে বা মানতে বাধ্য হয়। সমাজপতিরা সমাজে ঘোষণা দিলেন যে, ‘আজ থেকে ঢেউপাশার রমণীমোহন গোস্বামী যে যে শিষ্যবাড়িতে অথবা কীর্তন আসরে উপস্থিত থাকবেন সেই সেই জায়গায় অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবে এক কাতারে।’’
রূপককান্তি বলেন, রমণীমোহন কয়েক হাজার গান রচনা করে সেগুলিতে নিজে সুরারোপ করেছেন। গানগুলি অধিকাংশই দেহতত্ত্ব ভিত্তিক। তিনি বলেন, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, নাথপন্থ, সহজিয়া বৈষ্ণবধর্ম, সুফি ও বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে দেহতত্ত্ব একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। হিন্দুতন্ত্রে দেহের বিভিন্ন চক্র এবং বৌদ্ধতন্ত্রে দেহের ভেতরের বিভিন্ন কায়-এর কল্পনা করা হয়েছে। সাধনার পথে এই সব চক্র এবং কায়-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রমণীমোহন খুব সুরেলা কণ্ঠে কীর্তন গাইতেন। তাঁর রচিত সহস্রাধিক লোকসংগীত, দেহতাত্ত্বিক ও গুরুভজনের সংকলিত গ্ৰন্থ ‘সংগীত কুসুম’ মুদ্রিত এবং প্রকাশিত হয়েছে ১৩৩৩ বাংলায়। ‘সংগীত কুসুম’ আজও বাংলাদেশ ও ভারতে তাঁর অসংখ্য অনুসারী স্বযত্নে লালিত করছেন। এছাড়া আরও বহু গ্রন্থ রচনা করে গেছেন রমণীমোহন।
‘শ্রীহট্ট প্রতিভা’র উদ্ধৃতি দিয়ে রূপককান্তি আরও বলেন, রমণীমোহনের মতবাদ ও ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়ে একে একে বহুজন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকেন। বৈষ্ণব সহজিয়া মতের সিদ্ধসাধক রমণীমোহনের সহস্রাধিক শিষ্যের মধ্যে ভারতের করিমগঞ্জ জেলার বারইগ্রামের রাধারমণ গোস্বামীর নাম উল্লেখযোগ্য। বলেন, করিমগঞ্জের (ভারত) বারইগ্রাম আশ্রমের গৌড় দাস বাবাজি ও রাধারমণ গোস্বামী (উভয়েই শিক্ষামন্ত্ৰে দীক্ষিত), বিহাড়ার (কাছাড়, অসম) তমালতলা আশ্রমের গুরুমা আরতি দেবী, করিমগঞ্জের দুল্লভছড়া নিবাসী (স্টেশন রোডের সারদা ভবন) সারদাচরণ দাস, মৌলভিবাজারের তৎকালীন ইংরেজ সরকার পরিচালিত আদালতের পেশকার রমণচন্দ্র দেব (যার সমাধি এখনও ঢেউপাশায় প্রভুর সমাধির পাশে অবস্থিত), কৈলাশ সিংহ, হবিগঞ্জ (অধুনা বাংলাদেশ) লাখাই কৃষ্ণপুর নিবাসী বৈষ্ণব লোক-গবেষক চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, মৌলভিবাজার কমলগঞ্জ চৈত্রঘাট নিবাসী সুরেন্দ্রকুমার দেব (যিনি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে এসরাজ বিভাগের প্রধান শিল্পী), করিমগঞ্জের প্রথিতযশা শিক্ষক নিরোদবরণ গোস্বামী ও তাঁর ভাই রমা গোস্বামী সহ আরও অনেক অনেক গুণীজন।
তিনি জানান, অবিভক্ত ভারতের অসমের বিভিন্ন প্রান্ত যেমন কাছাড়, করিমগঞ্জ, ত্রিপুরা, বাংলাদেশের সিলেট, হবিগঞ্জ সহ অনেক প্রান্তে রমণীমোহনের ভক্ত-শিষ্যরা অন্তত শতাধিক আখড়া ও আশ্রম প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
গোস্বামী বলেন, রমণীমোহন ভট্টাচার্য ওরফে রমণীমোহন গোস্বামী মৌলভিবাজার জেলার প্রথম নাট্যকার। ১৯০৫ থেকে ১৯১১, এই সময়কালে তাঁর রচিত নাটকগুলি মঞ্চস্থ হয়েছে। তাছাড়া তাঁর আরও কিছু পরিচয় আছে। বৃহত্তর সিলেটের মৌলভিবাজারে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর আশ্রমে শত শত স্বদেশি আন্দোলনকারীকে নিরাপদে আশ্রয় দিতেন। মৌলভিবাজারের কুলাউড়ায় স্বদেশি আন্দোলনকারীদের থাকা-খাওয়ার জন্য ছয়জনের প্রচোষ্টায় ‘কর্মী ভবন’ নির্মাণ হয়েছিল। রমণীমোহন ‘কর্মী ভবন’টি তাঁর পুত্ৰের ছদ্মনামে ব্যবহার করতেন।
ব্ৰিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি অনেক তরুণকে উদ্বুদ্ধ করে স্বদেশি মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেনন। করিমগঞ্জের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ (ইংরেজি শিক্ষক) নীরদবরণ গোস্বামী (প্রয়াত), সিলেটের প্রয়াত নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী, হবিগঞ্জের চানখাবুল্লার প্রয়াত সুরেন্দ্র ভট্টাচার্য সহ বহু স্বনামধন্য যুবককে তিনি স্বদেশি মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, জমিদার ছিলেন বলে। তবে আড়াল থেকে বিপ্লবীদের সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন রমণীমোহন।
‘শ্রীহট্ট প্রতিভা’ গ্রন্থে প্রভু রমণীমোহনের জীবনী ও নানা ঘটনা, বিশেষ করে বহু অলৌকিক ঘটনাবলি উল্লেখ্ করেছেন নরেন্দ্রকুমার গুপ্তচৌধুরী।
রমণীমোহনের সুপুত্র ধীরেন্দ্র গোস্বামী ওরফে রাধিকামোহন গোস্বামী ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধে ‘ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন’-এর গেরিলা বাহিনীর একজন প্রথমসারির মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকের দায়িত্ব ভূমিকা পালন করেছেন। রাধিকামোহন গোস্বামী জাতীয়স্তরের একজন প্রথিতযশা সাংবাদিকও ছিলেন। পাকিস্তান আমলে এবং পরে বাংলাদেশ আমলে রাধিকামোহন গোস্বামীর সমস্ত সম্পত্তি সরকার ও ভূমিখেকোরা দখল করে নেয়। ৭১ সালে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জমিদারি ও বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে স্থানীয় রাজাকার এবং পাকবাহিনী। তবে সবকিছু আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিলেও প্রভু রমণীমোহনের মূল আবাসন ও সমাধিমন্দিরের ক্ষতি করতে পারেনি। সামান্য কিছু এখনও সংরক্ষিত আছে, জানান রূপককান্তি গোস্বামী।
প্রভু রমণীমোহন গোস্বামীর জন্ম হয়েছিল ১৮৭৮ ইংরেজি (১২৮৫ বাংলা) সালে। বাংলা)। ভারতের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি রমণীমোহন গোস্বামী। তার আগে ইংরেজি ১৯২৬ সালে দেহরক্ষা করেন তিনি।