নিজস্ব প্রতিনিধি, কল্যানপুর, ১৫ জানুয়ারি : বাংলাবর্ষের ক্যালেন্ডারে পৌষ মাসের শেষ দিন। বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের অন্যতম উৎসব। পৌষ পার্বণ মানেই ঘরে ঘরে পিঠে পুলির দারুন আয়োজন। সাধ্য মতো বাঙালির প্রতি ঘরেই এই আয়োজনে পারস্পরিক মেলবন্ধনে সামিল হয় আপামর সাধারণ মানুষ। এই পার্বণের অন্যতম আকর্ষণীয় আয়োজন গ্রামীণ সংস্কৃতির ধারা বাড়ি বাড়ি নগর কীর্তণ। আট থেকে আশি, কিশোর কিশোরী সহ প্রবৃদ্ধরাও সুসজ্জিত হয়ে নগর কীর্তণে গা ভাসান।
সমাজের প্রতিটি এলাকার প্রত্যেক পাড়া মহল্লায় দলে দলে খোল করতাল সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নগর কীর্তণ অনুষ্টিত হয়। জনে জনে মেঠোপথে প্রাচীনকাল থেকেই আজো পৌষের সংক্রান্তিতে পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে নগর কীর্তনের রেওয়াজ চলছে।
এ যে বাঙালির কত বড় ঐতিহ্য, ধর্মে আবদ্ধ হয়ে পড়ায় তা ধরা পড়ে সেই দিনে। কীর্তনকে কোনো ভাবেই ধর্মের বাইরে ভাবা যায় না। প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তির সকালে পদ-কীর্তন শুরু হয়। গ্রাম থেকে শহরের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ একসঙ্গে গলা মেলান। লুটের প্রসাদ কুড়িয়ে নিতে করেন কাড়াকাড়ি।
প্রায় মাসাধিককাল আগে থেকেই কীর্তন নিয়ে ভিন্ন ভাবনায় কাজ শুরু হয়ে যায় পাড়ায় পাড়ায়। ছোট-বড় ধনী-দরিদ্র মধ্যবিত্ত সমাজকেও কীর্তনে সামিল করা হয়। আগাম প্রস্তুতিতেই পৌষ সংক্রান্তির সকালে বেরিয়ে পড়েন সবাই। আবাল বৃদ্ধ বনিতারা বিভিন্ন রঙ্গে সজ্জিত হয়ে শ-দেড়েক লোক কীর্তনে শামিল হয়।খোল-করতাল, হারমোনিয়াম, চন্দনের ফোঁটা, হরিধ্বনি, প্রসাদ বিতরণ, খিচুড়ি পরিবেশন সবই থাকে এই পার্বনে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেকটাই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে পৌষ সংক্রান্তির নগর কীর্তন।
আগেকার দিনে‘ অনেক কিশোর-কিশোরীও কীর্তন করে পথে হেঁটেছে। কিন্তু এখন আর তা দেখা যায়না। এ ধরনের সাংস্কৃতিক পরম্পরা জিইয়ে রাখা জরুরি বলে প্রবীনদের অভিমত।
ধর্মীয় আচারের বাইরে বেরিয়ে কীর্তনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ আমাদের সংস্কৃতি। এ আমাদের সঙ্গীত। এতে সর্বস্তরের লোক যোগদান করা কাম্য।’’ সে জন্যই আমাদের বেশি করে যোগ দেওয়া প্রয়োজন। তবেই সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবেন, কীর্তনের গুরুত্ব। প্রবীন কীর্তনীয়া বলেন, ‘‘আমরা পরম্পরা রক্ষা করতে চাই। একই সঙ্গে শহর ও শহরতলির মানুষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাও আমাদের লক্ষ্য।’’
তাঁর বক্তব্য, কীর্তনের মাধ্যমে চৈতন্যদেব কুসংস্কার দূর করা এবং মানুষের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করে গিয়েছেন। এতে শুধু বাংলা নয়, ভারতের নানা অঞ্চলের সংস্কৃতির গতিপথ প্রভাবিত হয়। ফলে কীর্তন সামাজিক ঐক্যের অন্যতম মাধ্যম। গ্রাম-শহরকে একাকার করে দিতে হবে। তবেই পৌষ পার্বণে নগর কীর্তণের প্রকৃত সার্থকতা মিলবে।