BRAKING NEWS

বৌদ্ধ

যীষ্ণু দেববর্মা

বৌদ্ধ হল সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক উপলব্ধি যা কোন ব্যাক্তি বিশেষকে এই উপাধি দেওয়া হয়ে থাকে।  এর অর্থ একজন ব্যক্তি বিশেষ যিনি আধ্যাত্মিকচেতনায় জাগরিতকে বোঝানো হয় অর্থাৎ বাস্তবতা ও সত্যের প্রতি জাগ্রত হতে হবে।

তাঁর নাম ছিল সিদ্ধার্থ গৌতম।  তিনি আধুনিক নেপাল ও উত্তর ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য লুম্বিনিতে ৪৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।  তিনি যোদ্ধা জাতি বা ক্ষত্রিয় শাসক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।  জন্মের আগে তাঁর মা মায়া, একটি সাদা হাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং জ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে শিশুটি ভবিষ্যতে একজন মহান আধ্যাত্মিক নেতা হয়ে উঠবেন।  

তাঁর পিতা শাক্য রাজবংশের রাজা শুদ্ধোদন এবং কোশল রাজ্যের শাসক এবং তিনি চিন্তিত ছিলেন যে তাঁর পুত্র বিশ্বের সমস্ত আরাম-আয়াস, ভোগবিলাস পরিত্যাগ করবে ; তাই  এমন কোনও মানুষের দুঃখ-কষ্ট যেন না দেখে তার জন্য চারপাশে উঁচু প্রাচীর তৈরি করে রাখেন সিদ্ধার্থকে রক্ষা করার জন্য এসব দুঃখকষ্ট যাতে তাঁর পুত্র আধাত্মিক চিন্তাচেতনায় ডুবে যেতে না পারে।   মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাঁর পিতা তাঁকে এক সুন্দরী নারী যশোধরের সাথে বিয়ে করিয়ে দেন, ফলে রাহুল নামে একটি পুত্রসন্তানও জন্ম দেন।

২৯ বছর বয়সে সিদ্ধার্থের চার যাত্রার পর তাঁর জীবন বদলে যায়।  তাঁর প্রথম যাত্রায় তিনি একজন বৃদ্ধ লোককে দেখেছিলেন এবং সেই বৃদ্ধকে দেখে তিনি তাঁর সারথীকে প্রাসাদে ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন; অতঃপর তিনি কয়েকদিন ধরে চিন্তা করেছিলেন যে বৃদ্ধ এবং দুর্বল হওয়ার অর্থ কী।  তাঁর দ্বিতীয় যাত্রায় তিনি একজন অসুস্থ ব্যক্তি রোগে আক্রান্তকে দেখেন এবং তৃতীয় যাত্রায় একটি শবযাত্রা দেখতে পান।  এই সমস্ত দৃশ্যগুলি যুবরাজকে জীবনের অস্থায়ীত্ব দিকটি প্রভাবিত করতে বাধ্য করেছিল এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে সাধারণ মানুষ অথবা ক্ষমতাবান, ধনী অথবা গরীব প্রত্যেককেই এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।  তাঁর চতুর্থ যাত্রায় তিনি একজন পন্ডিত ব্যক্তির সাথে মিলিত হয়েছিলেন এবং দুজনের কথোপকথনের সময় তিনি অবশেষে উপলব্ধি করেছিলেন যে, অস্তিত্বের এই দুর্দশার আধ্যাত্মিক সমাধান পাওয়া সম্ভব।

তরুণ যুবরাজ যে প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হচ্ছিলেন সেগুলি শুধুমাত্র তাঁর একার নয় বরং সমগ্র মানবতার ।  কিভাবে আমরা জীবনে পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে পারি?  কিভাবে আমরা এই দুঃখকষ্টকে কাটিয়ে উঠতে পারি?  মানুষের অস্তিত্বের অর্থ কী?  চিরস্থায়ী সত্যকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায়?  এই প্রশ্নগুলি সিদ্ধার্থকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তার উত্তর এবং সমাধান খুঁজতে তিনি তাঁর পরিবার এবং রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দূরে সরে আসেন এবং সাংসারিক জীবন ত্যাগ করেন। 

সেই দিনগুলোতে বিচরণরত সন্ন্যাসীরা যারা পার্থিব প্রয়োজনীয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তাঁদের একটি সাধারণ দৃশ্য ছিল এই ভারতে এবং মহান জ্ঞানের আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের খুঁজে পাওয়া যেত।  সিদ্ধার্থের প্রথম শিক্ষক আজরা কালামা তাঁকে ঔষুধের সমস্ত কৌশল শিখিয়েছিলেন।  যুবরাজ দেখতে পেয়েছিলেন যে ধ্যান-সাধনা তাঁকে অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং ক্ষণিক আনন্দ দেয় কিন্তু সেটা এই পার্থিব দুঃখকষ্ট সম্পর্কে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।  এরপর তিনি উদ্দাকের অধীনে পড়াশোনা করেন।  রামাপুত্ত তাঁকে “শূন্যতার” অন্দরে প্রবেশের কৌশল শিখিয়েছিলেন।  এটিও তাকে ক্ষণিক আনন্দ এনে দিয়েছিলেন কিন্তু “কেন মানুষের অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী এবং দুঃখ কষ্টে পরিপূর্ণ ছিল?” এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।

তারপরে তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ কৌশল (প্রানায়াম) এর দিকে মনোনিবেশ করেন, যা বাতাস গ্রহণ কমানোর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল এতে শ্বাস নেওয়া খুব কমই সম্ভব হতো।  অতঃপর তিনি কঠোর উপবাসের দিকে মনোনিবেশ করেন যা তাঁর শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করেছিল কিন্তু সেটাও তাঁকে যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বের হয়েছিল তার উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করেনি।

তাই তিনি একটি যুক্তিগত সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে অতিরিক্ত ভোগ অথবা কঠোর পরিহারই সমাধান নয়।  সমাধানটি “মধ্যপন্থা” অবলম্বনের উপরই বর্তায় যা তাঁর শিক্ষার মূল পদ্ধতি হয়ে ওঠে।

যখন তিনি তার অনুসারীদের কাছে এই মধ্যপন্থা অবলম্বনের কথা বলেছিলেন, যারা বছরের পর বছর ধরে তাঁর সাথে ছিল তারা চিন্তা করেছিল যে তিনি পার্থিব আনন্দ/ভোগবিলাস এবং ত্যাগের মধ্যে একটি সমঝোতার পথ বেছে নিচ্ছেন।  তাঁর ‘মধ্যপন্থা’ সিদ্ধান্ত নিয়ে হতাশ হয়ে তাঁর অনুগামীরা তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন।  এখন গৌতম সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন;  পরিবার, বন্ধু, অনুগামী, খ্যাতি কিছুই নেই কিন্তু যা অবশিষ্ট ছিল তা হল চূড়ান্ত সত্যটি খুঁজে পাওয়ার দৃঢ় সংকল্প যা এই পৃথিবীতে দুঃখের কারণ ছিল।  

তিনি সত্য এবং মানুষের যন্ত্রণার সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত আরও একটি পদক্ষেপ নিতেও অস্বীকার করেছিলেন।  

তিনি একটি বিশাল গাছের নীচে বসে ধ্যানে মগ্ধ হলেন।  এক রাতের মধ্যে তিনি যা খুঁজিতেছিলেন তা খুঁজে পেলেন- “জন্ম এবং পুনর্জন্মের ক্রমাগত চক্র”।  

তিনি দেখেছেন কিভাবে মানুষ তাদের নিজস্ব জীবন তৈরি করেছে এবং তারা তাদের নিজস্ব কর্মের অধীন।  তিনি চাহিদা এবং কষ্টের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র দেখেছিলেন।  এগুলি একই মুদ্রার দুটি দিক- ‘আজ যা আপনাকে আনন্দ দেয় তা আগামীকাল ব্যথার কারণ হবে এবং সেটার উল্টোটাও হবে।’ এই চাঁদনী রাতে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন অর্থাৎ সিদ্ধি লাভ করেছিলেন।  তিনি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলেন।

তিনি তাঁর পাঁচজন শিষ্যকে খুঁজতে গিয়েছিলেন যারা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।  তারা সারনাথের একটি হরিণ পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।  তিনি তাঁর ধ্যানে যা দেখেছিলেন তা তাদের বললেন।  প্রথমে তারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিল কিন্তু দিনের পর দিন তাঁর শিক্ষার শক্তি এবং তাঁর নিখুঁত উপস্থিতির মাধ্যমে, তিনি তাদের জ্ঞানার্জনের দিকে নিয়ে যান।  তারপর থেকে তিনি যা অর্জন করেছিলেন তা অর্জনের জন্য তাঁর সংঘ (ভ্রাতৃত্ব) শিক্ষা দিয়ে জায়গায় জায়গায় ঘুরে ঘুরে ৪৫ বছরের তাঁর আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করেছিলেন।  বৌদ্ধধর্ম শেখায় যে দৃঢ় সংকল্পের সাথে এবং “মধ্যপন্থা” অনুসরণ করে মানবতা জীবনের অজাগ্রত অবস্থা থেকে জাগ্রত হতে পারে যাকে বৌদ্ধ বলেছেন “নির্বাণ” – দুঃখ-কষ্ট থেকে প্রকৃত মুক্তি।

তিনি বললেন, “মনকে নিয়ন্ত্রণ না করলে মন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।”  ভারতীয় ঋষি ভত্রীহরি এটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:

 “আপনার চিন্তাধারাকে খেয়াল রাখুন,

 কারণ এগুলো আপনার মুখে শব্দ হয়ে ওঠে,

 ভেবেচিন্তে কথা বলুন,

 কারণ এগুলো আপনার কর্ম হয়ে ওঠে,

 ভেবেচিন্তে কাজ করুন,

 কারণ এগুলো আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়,

 আপনার অভ্যাসগুলোকে খেয়াল করুন,

 কারণ এগুলোই আপনার ভবিষ্যৎ।

 প্রাচীন ঋষিগণ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, একজন ব্যক্তির ভবিষ্যৎ তার মন দ্বারা নির্ধারিত হয়। মানুষের মনেই ভবিষ্যতের ‘প্রতিক্রিয়ার ধারা’ শুরু হয়।  কারন সেটা বৌদ্ধের জন্যও সত্য ছিল।  একজন তরুণ যুবরাজ হিসাবে মানুষের দুর্দশা, দুঃখ-কষ্ট দেখার পর, তাঁর চিন্তাভাবনাগুলি কীভাবে মানবতাকে দুঃখকষ্ট থেকে ‘মুক্ত’ করা যায় তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন, যার ফলে তাকে এগুলো থেকে স্থায়ী “মুক্তি” অর্জনের উপায় এবং তার সন্ধানের দিকে পরিচালিত করেছিলেন, যা “স্বাভাবিক জীবন” হিসাবে বিবেচিত হতো। 

 তিনি সেই তথাকথিত স্বাভাবিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে এই ভোগান্তিগুলি ছিল ‘নিজস্ব তৈরি’ – আমরা স্বয়ং নিজেদের ভোগান্তির কারণ।  জীবনের দুঃখ-কষ্টকে উপড়ে ফেলতে ধ্যানের সূচনাই হল হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে মনকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র উপায়- “মানুষের মনই সবকিছু”।  সুতরাং আমরা যা ভাবি তাই হয়।

বৌদ্ধকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর ধারণা কী এবং তিনি প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন যে, এটি এমন কিছু নয় যার জন্য তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।  তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর অনুসন্ধান ছিল দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য যা মূলত: সহিংসতা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল বা সেটিকে তিনি ‘হিংসা’ বলে অভিহিত করেছেন। এবং তিনি তাঁর উত্তর খুঁজে পেয়েছেন যে চিন্তা ও কর্মের ‘অহিংসা’র মধ্যে।  তিনি আরও বিশদভাবে বলেছেন যে, হিংসা এমন কিছু নয় যা শুধুমাত্র কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।  বরং সহিংসতা নিছক কর্মের চেয়েও অনেক বেশি।  চিন্তার হিংস্রতা যেমন ঘৃণা, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি মানুষের মনকে কলুষিত করে এবং মানবজগতে দুঃখ-যন্ত্রণা সৃষ্টি করে।

 বৌদ্ধধর্ম অনেকের কাছে একটি যুক্তিবাদী ধর্ম এবং অনেকে একে “একটি ঈশ্বরবিহীন ধর্ম” বলেও অভিহিত করেছেন।  বৌদ্ধ ধর্মের উদ্দেশ্য আসলে এমন কিছু অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভরশীল নয় বরং দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে কাটিয়ে উঠতে মানুষের মনন ও তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার উপরই আলোচিত হয়েছে। এটা শুধুমাত্র ‘মন’ যা আমাদের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।  আমরা আমাদের মনের দাস, না প্রভু হতে চাই সেটা একান্তই আমাদের ব্যাপার।  

আমরা যদি মনের দাসত্বকে বেছে নিই, তাহলে আমরা অসারতার জীবন যাপন করব- “নেতিবাচক এবং কষ্ট দ্বারা চালিত জীবন অর্থহীন”।  বৌদ্ধ বলেছেন ধ্যান ও কর্মের বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে আমরা যদি আমাদের মনকে আয়ত্ত করতে পারি, আমরাও বৌদ্ধত্ব লাভ করতে পারি- সেই অভ্যন্তরীণ চোখ যেটি কেবল বিশ্বকে দেখে না, সত্যজ্ঞানের আলোকে দেখায়।  এটি বৌদ্ধের শিক্ষা সম্পর্কে আমার প্রাথমিক উপলব্ধি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *