দুর্গাপুর, ১৮ জানুয়ারি (হি. স.) পাচারের আগেই এসটিএফের জালে ধরা পড়ল ব্রাউন সুগার তৈরীর সামগ্রীসহ পাচার চক্র। বাজেয়াপ্ত হয়েছে কয়েক কোটি টাকার মাদক তৈরীর কাঁচামাল। বুধবার ঘটনাটি ঘটেছে, ১৯ জাতীয় সড়কের ওপর কাঁকসা থানার বাঁশকোপা টোলপ্লাজায়। প্রশ্ন উঠেছে, আসানসোল, দুর্গাপুর, পানাগড়কে আন্তঃরাজ্য মাদক পাচারকারীদের কি করিডর হিসাবে ব্যাবহৃত করছে? ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে কমিশনারেট পুলিশ।
ঘটনায় জানা গেছে, বুধবার দুপুর নাগাদ গোপন সুত্রে খবর পেয়ে ১৯ জাতীয় সড়কের বাঁশকোপা টোলপ্লাজায় হানা দেয় এসটিএফ। এছাড়াও সঙ্গে ছিল কাঁকসা থানার পুলিশ। ওইসময় উত্তরপ্রদেশের বারেলি থেকে কলকাতা গামী একটি পণ্যবাহী লরি আটক করে এসটিএফ বাহিনী। লরি থেকে চার বস্তা মাদক তৈরীর পাউডার। যার সব মিলিয়ে ওজন প্রায় ১ কুইন্টাল। এছাড়াও ২ ব্যারেল ব্রাউন সুগার তৈরীর লিক্যুইড আসিটিক অ্যানাহাইড্রেড। যার ওজন প্রায় ১ কুইন্টাল ১০ কেজি। সব মিলিয়ে প্রায় কয়পক কোটি টাকার ব্রাউন সুগার তৈরীর কাঁচামাল আটক হয়েছে। লরিটিকেও আটক করেছে এসটিএফ। ঘটনায় চারজনকে আটক করেছে। জানা গেছে, মাদক তৈরীর ওইসব সামগ্রী নদিয়ার পলাশিপাড়া যাচ্ছিল। জাতীয় সড়কের ওপর কাঁকসার বাঁশকোপা এলাকায় হস্তান্তর হওয়ার কথা ছিল। তারজন্য আগাম দুজন মাদক পাচারকারী একটি ছোটো চারচাকা গাড়ীতে হাজির ছিল। এসটিএফ লরির চালক খালাসি সহ মোট ৪ জনকে আটক করেছে। আটক হওয়া ছোটো চার চাকা গাড়ীর দুজন নদীয়ার বাসিন্দা। মুলত, কালিয়াচক, লালগোলা, পলাশীপাড়া ওইসব এলাকায় ব্রাউন সুগার তৈরীর রমরমা কারবার চলে। গতবছর মে ও জুলাই মাসে নদিয়া, মুর্শিদাবাদের কিছু এলাকায় ব্রাউন সুগার তৈরীর কাঁচামাল আসিটিক অ্যানাহাইড্রেড উদ্ধার করে এসটিএফ। ব্রাউন সুগার তৈরীর আসিটিক অ্যানাহাইড্রেড বাজার মূল্য লিটার প্রতি ৫০-৬০ হাজার টাকা। মুলত স্বচ্ছ ও ঝাঁঝালো গন্ধ যুক্ত তরল। নীল রং’য়ের ড্রামে পরিবাহিত হয়। এটি পোস্তর আঠার গুড়োতে মিশিয়ে ওই মাদক দ্রব্য তৈরী করে। এদিকে খবর চাউর হতেই শিল্পাঞ্চলজুড়ে বিস্তর চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে।
শিল্পাঞ্চল আসানসোল, দূর্গাপুর, পানাগড় অঞ্চলে অবৈধভাবে মাদক পাচারের নতুন কিছু নয়। গত ১৬ জানুয়ারী গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বাঁকুড়া বড়জোড়া দেজুড়ী পেট্রোল পাম্পের কাছে এসটিএফ হানা দেয়। ওইসময় গাঁজ ভর্তি পিকআপ ভ্যান আটক করে এসটিএফ ও পুলিশ। পিকআপ ভ্যান থেকে ৩৩৬ কেজি ২২৫ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করে এসটিএফ। জানা গেছে, গাঁজা ভর্তি ওই পিকআপ ভ্যান উড়িষ্যার সম্বলপুর থেকে ধানবাদ যাচ্ছিল। ঘটনায় সরফরাজ আনসারি, সুরজ ভূঁইয়া নামে দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। দিন পনেরো আগে নাকা চেকিংয়ের সময় রকি ডোম নামে এক পাচারকারীকে ২২ গ্রাম ব্রাউন সুগার মাদক সহ গ্রেফতার করে রানীগঞ্জ থানার পুলিশ। গত ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর অন্ডালের বহুলা পার্বতী মন্দির এলাকায় ১৮.০৯ গ্রাম বাউন সুগারসহ এক পাচারকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধৃত পাচারকারীর নাম জামির মোমিন বীরভুমের দুবরাজপুরের বাসিন্দা। বাজেয়াপ্ত করা হয় তার মোটরবাইকটি। তার বিরুদ্ধে মাদক দ্রব্য পাচারের অভিযোগে ১৯৮৫ সালের এনডিপিএস আইনের ধারায় মামলা দায়ের করে পুলিশ। তার আগে গত ৮ নভেম্বর রাত্রে হরিপুর উখড়া রোডের ডায়মন্ড মোড়ে নাকা চেকিংয়ের সময় পাচারের আগে ব্রাউন সুগার সহ দুই পাচারকারী ধরা পড়ে। ধৃত দুই মাদক পাচারকারীর নাম রাজীব সাউ ও আস্তিক বোস রানীগঞ্জের বিএন মালিয়া রোডের বাসিন্দা। তাদের কাছে ১৬.২৩ ব্রাউন সুগার উদ্ধার হয়। তারও আগে গত ২৭ সেপ্টম্বর লক্ষাধিক টাকার ব্রাউন সুগার সহ অন্ডালের কাজোড়া লছিপুর এলাকায় দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছে প্রায় ২৩ গ্রাম ব্রাউন সুগার উদ্ধার করেছে। ধৃতদের নাম, নিতীশ কুমার সাউ (গুলু) ও আকাশ ভূঁইয়া দুজনেই কাজোড়ার লছিপুর কলোনীর বাসিন্দা। ২০২১ সালের জুলাই মাসে পানাগড় -মোরগ্রাম সড়কের ওপর কাঁকসার হাসপাতালমোড় সংলগ্ন আন্ডারপাশে মাদক সহ দুজন পুলিশ ও এসটিএফের জালে ধরা পড়ে। ধৃতদের সঞ্জিব ভক্ত নদিয়ার পলাশিপাড়ার বাসিন্দা, আর একজন বিধান বৈদ্য বাঁকুড়ার সোনামুখির ডিহিপাড়ার বাসিন্দা। তাদের কাছে প্রায় ৯৭০ গ্রাম হেরোইন, যার বাজার মুল্য প্রায় কোটি টাকার ওপর। এছাড়াও ১০২০ গ্রাম অ্যালপ্রাজোলাম উদ্ধার হয়েছে। এই নেশার ঔষধটি মুলত ঘুমের জন্য ব্যাবহৃত হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের গোড়াতে কাঁকসার বনকাটির ১১ মাইল এলাকা থেকে প্রশান্ত রায় নামে এক মাদক পাচারকারী ধরা পড়ে। তার কাছ থেকে ২৬০ গ্রাম ব্রাউনসুগার উদ্ধার হয়। যার আনুমানিক মুল্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। তার আগে ওইবছরই গত ৫ নভেম্বর দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে মনিরুল শেখ, নামে এক যুবককে প্রায় কোটি টাকার হেরোইন সহ গ্রেফতার করে পুলিশ। নদিয়ার পলাশিপাড়া থানা এলাকার বাসিন্দা মনিরুল শেখ উত্তরপ্রদেশ থেকে এই মাদক পাচারের উদেশ্য নিয়ে দূর্গাপুর স্টেশনে নেমেছিল। দুর্গাপুর ষ্টেশনে নামার পর সেখান থেকে স্টেশন বাস স্ট্যান্ডের পিছনের রাস্তা ধরে বাইরে বেরিয়ে আসছিল। ওই সময় পুলিশ সন্দেহজনক ভাবে তাকে আটক করে। তার কথায় অসঙ্গতি থাকায় পুলিশের সন্দেহ হয়। তল্লাশি করতেই তার কাছ থেকে প্রায় ৫০০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার হয়। তারপরই পুলিশ মনিরুলকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও ২০১৮ সালের আগষ্ট মাসে ২৮০ গ্রাম হেরোইন ও আগ্নেয়াস্ত্র সহ তিনজন সুপারিকিলার ধরা পড়ে দুর্গাপুর বেনাচিতির উত্তরপল্লী এলাকায়। মাস কয়েক আগে ওডিশা থেকে এরাজ্যে পাচারের আগে কোকওভেন থানার শ্যামপুর মোড় এলাকায় কয়েক লক্ষ টাকার গাঁজা সহ ধরা পড়ে পাচারকারীরা। তারপর এদিনের ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই শোরগোল পড়েছে শিল্পাঞ্চলজুড়ে। প্রশ্ন এখানেই, একের পর এক ঘটনায় মাদকপাচারকারীরা কি শিল্পাঞ্চলকে করিডর হিসাবে ব্যাবহার করছে? যদিও পুলিশ জানিয়েছে, ” নাকা চেকিং জারি আছে। ধৃতদের আদালতে রিমান্ডে নেওয়া হবে। ঘটনার তদন্ত চলছে।”