BRAKING NEWS

শিলচরে সংখ্যালঘু অধিকার দিবসে জাতিভেদ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান, পুরস্কৃত পাঁচ সাংবাদিক

শিলচর (অসম), ১৮ ডিসেম্বর (হি.স.) : শিলচর প্রেস ক্লাবে আজ রবিবার নাগরিক সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত সংখ্যালঘু অধিকার দিবসের অনুষ্ঠানে জাতিভেদ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন বক্তারা।

সঞ্জীত দেবনাথের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে পাঁচ কৃতী সাংবাদিককে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। পুরস্কৃত সাংবাদিকরা যথাক্রমে গতি দৈনিকের বরিষ্ঠ সাব-এডিটর সিদ্ধার্থকুমার দাস, প্রান্তজ্যোতি দৈনিকের সাব-এডিটর অমলকুমার লস্কর, ইস্টার্ন ক্রনিকল ইংরেজি দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার শংকু শর্মা, দৈনিক যুগশঙ্খ-এর এনামুল কবির লস্কর এবং বিটিএন চ্যানেলের নিউজ এডিটর সোমশিখা মজুমদার। তাঁদের উত্তরীয় পরিয়ে শংসাপত্র, মেমেন্টো, পুষ্পস্তবক ও নগদ অর্থ উপহার সহ পুরস্কার সামগ্রী তুলে দেন অতিথিরা।

সংখ্যালঘু অধিকার দিবসে আলোচনার বিষয় ছিল “জাতিভেদ বৈষম্যের অবসান না ঘটলে আধুনিক শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়”। এই বিষয়ের উপর বিশদ আলোচনাসভায় নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেন উপস্থিত বক্তারা। এদিন শুরুতে নাগরিক সংসদের প্রধান সম্পাদক শংকর দে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন।

শংকর দে বলেন, ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘে সংখ্যালঘু অধিকার দিবস উদযাপনের দিন নির্ধারিত হয়েছিল। বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা, জাতি জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্থান বিশেষে সংখ্যালঘুর ধারণা বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে শংকর বলেন, ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অসমে বাঙালি তথা অ-অসমিয়া জাতিগোষ্ঠীর লোকজনদের উপর নানাভাবে অত্যাচার নেমে আসে। বহুক্ষেত্রে বাঙালিদের বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কিন্তু এটাও দেখা যায়, ধর্মীয় ভিত্তিতে সৃষ্ট দেশগুলোতে শরিয়ত নিয়মে সম-অধিকার রক্ষা করেই রাষ্ৰ্স পরিচালনা হয়ে থাকে। গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা সহ পাশ্চাত্য দেশগুলোতে বসবাসকারী ভারতীয় মূলের নাগরিকরা উচ্চপদে আসীন হতে পারছেন।

সংখ্যালঘু অধিকার দিবসের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শংকর দে আরও বলেন, রাষ্ট্ৰ পরিচালন নীতি সঠিকভাবে নির্ধারণের বিষয়টির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরিৰ ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়ায় ২৭ লক্ষ জনগণের আধারকার্ড আটকে রয়েছে কীভাবে? সংখ্যালঘু অধিকার দিবসে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেন শংকর দে।

সমাজসেবী বিষ্ণুপদ দাস বলেন, জাতিভেদ মানুষের রক্তে রক্তে সম্পৃক্ত হয়েছে। ধর্মান্ধতা, উগ্রজাতীয়তাবোধ, ভাষিক ভেদাভেদ প্রভৃতির অবসান ঘটাতে হলে আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনাকে জাগ্রত করতে হবে। পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে সত্যিকার অর্থে আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে পারলে আধুনিক সমাজের সার্থকতা প্রকট হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন বিষ্ণুপদ দাস।

সারা কাছাড়-হাইলাকান্দি-করিমগঞ্জ ছাত্র সংস্থার (আকসা) উপদেষ্টা রূপম নন্দী পুরকায়স্থ অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে বলেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রম করার পরও ভারতবর্ষ উন্নয়নশীল দেশে পরিণ হতে পারেনি। বাস্তবিক অর্থে বহু গ্রামাঞ্চলে অদ্যাবধি উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। ক্ষমতার যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। আক্ষরিক অর্থে যাঁরা সংখ্যালঘু তাঁরা সংখ্যাগুরু সেজে সংখ্যালঘুদের ওপর নানাভাবে শোষণ-শাসন চালাচ্ছে। চাকরি, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। তিনি সমঅধিকার সমবিচারের দাবি জানান।

শিলচর প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি রিতেন ভট্টাচার্য বলেন, ভারতবর্ষের বহু জায়গায় বিদ্যমান অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার, ভাষিক ভেদাভেদ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে হলে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা ছাড়া বিকল্প রাস্তা নেই। তাই শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে জাতিভেদ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠন সম্ভব হয়ে উঠবে।

বিশিষ্ট আইনজীবী তথা তফশিলি জাতি উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান নীহাররঞ্জন দাস বলেন, ভারতবর্ষে অনেক সমস্যা আছে। তবুও উদার মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে সমগ্র বিশ্ববাসীকে দিশা দেখাচ্ছে ভারত। জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের ওপর ভেদাভেদের বিষয়ে বলেন বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক চর্চার ওপর নির্ভর করেই প্রগতির পথে এগোতে হবে। সমাজে বিদ্যমান প্রগতিশীল মুনিঋষিদের প্রদর্শিত রাস্তা অনুসরণ করে বহু সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রাচীনকালের গুরুকুল ও ব্রিটিশ প্রিরিয়ডে শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনওরকমের ফিজ বা শুল্ক নেওয়ার প্রবণতা ছিল না। তখন শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধ ছিল। তথাপিও আমাদের দেশে সহানুভূতি উদারতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ মূলত সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে নজিরবিহীন উদাহরণ।

বরিষ্ঠ সাংবাদিক রত্নদীপ দেব বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর চলে আসা নানারকমের চাপ, নিপীড়ন ও অত্যাচারের পরিসর অনেক বৃহত্তর। সংখ্যালঘু নির্যাতনের শেকড় অনেক গভীরে। ব্যবহারিক শিক্ষায় প্রকৃত শিক্ষা অর্জনে এই বৈষম্যের উত্তরণে সঠিক পথ বেরিয়ে আসবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন রত্নদীপ দেব।

বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ বলেন, অনেক শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচার আচরণ পরিলক্ষিত হয়। তাই সমাজে বৈষম্যের দেওয়াল ভেঙে দিতে মানুষের চিন্তাভাবনা ও ব্যবহারিক দিকের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ।

অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার খালিক চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে একই ধর্ম একই জাতির মধ্যে অভ্যন্তরীণ বৈষম্যের ঘটনা ঘটে থাকে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে গিয়ে বহুক্ষেত্রে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে সমাজে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। তাই অত্যন্ত সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে কৌশলে এ ধরনের রাজনৈতিক বিভ্রান্তিকর পরিবেশকে এড়িয়ে চলে জাতিভেদের অবসান ঘটিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানান খালিক চৌধুরী।

সংখ্যালঘু অধিকার দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানের সভাপতি সঞ্জীত দেবনাথ বলেন, সাধারণত শক্তিশালী পশু দুর্বল পশুর উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ মানুষের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ করা কোনওমতেই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে আধুনিক যুগে সুষ্ঠু ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে সবাইকে সংস্কার ও উদার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসলে সমাজে কোনওরকমের বৈষম্য থাকবে না।

জাতিভেদ বৈষম্য অবসানের ক্ষেত্রে বেদান্ত দর্শনের ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য পেশ করেন ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার। এছাড়া বক্তব্য পেশ করেন প্রেস ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ চিন্ময় নাথ, মৃদুলা ভট্টাচার্য। উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক শিবাজী ধর, বরাক উপত্যকার চিত্র সাংবাদিক সংস্থার সভাপতি হিমাংশু কুমার দে, সম্পাদক সুদীপ কুমার সিং, রাজদীপ দাম প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *