মালিডহর (অসম), ২০ অক্টোবর (হি.স.) : মেঘালয়ে বাঙালি নির্যাতনের প্রতিবাদে পৃথক পৃথক বিক্ষোভ প্রদর্শন, ধরনা কর্মসূচিতে মঙ্গলবার উত্তাল হয়ে উঠেছে আন্তঃরাজ্য সীমান্তবর্তী মালিডহর এবং নিউ মালিডহর অঞ্চল।
বাঙালি নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ‘আমরা বাঙ্গালী’র বিক্ষোভে কেঁপে উঠেছে অসম-মেঘালয় সীমান্ত মালিডহর এলাকা। অসম-মেঘালয়ের আন্তরাজ্য সীমান্ত এলাকায় সংগঠিত আজকের ঐতিহাসিক প্রতিবাদী বিক্ষোভে শামিল হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। তাঁদের ভিড়ে প্রায় দুই ঘণ্ট ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ হয়ে পড়ে। মঙ্গলবার দুপুর বারোটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত মালিডহরের জাতীয় সড়কের পাশে চলে বিক্ষোভ কর্মসূচি। এদিন বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠনের সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহণে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রায় সহস্রাধিক জনগণের উপস্থিতে প্রথমে জাতীয় সড়কের লক্ষ্মীছড়া থেকে মালিডহর সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা মিছিল করে মেঘালয়ে বাঙালি জনগণের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মুখরিত করে তোলা হয় গোটা অঞ্চল। পরে মালিডহরে গিয়ে জমায়েত হয়ে বাঙালি নির্যাতনের বিরুদ্ধে দুই ঘণ্টাব্যাপী ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। দুপুর বারোটা থেকে দুটা পর্যন্ত সড়ক অবরোধের পর মেঘালয়ে বাঙালি জনগণের উপর নির্যাতনের ধারাবাহিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত আরও এক ঘণ্টা সময় চলে বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য।
মেঘালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশের পেছনে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অবদান অনস্বীকার্য। এমন-কি স্বাধীনতার প্রাক্কালে সমগ্র তদানীন্তন আসাম অধুনা মেঘালয়ের শিলং, জোয়াই, লাড্রিমবাই সহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালিরা ছিলেন আদি বাসিন্দা। এমন তথ্য তুলে ধরে সাম্প্রতিককালে খাসি ছাত্র সংস্থার নেতৃত্বে বাঙালি জনগণের উপর শারীরিক মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত হেনস্তার তীব্র প্রতিবাদ জানান আন্দোলনকারীরা। এছাড়া বর্তমানে কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার রয়েছে। একইভাবে মেঘালয় ও অসমে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমানে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে মেঘালয়ে বাঙালি অত্যাচারের স্পর্শকাতর ঘটনায় পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ও উভয় রাজ্য সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে। তাই উভয় সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন বক্তারা।
সমগ্র বিশ্বে বাঙালি জনগণের গঠনমূলক অবদানের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মেঘালয়ে শীঘ্র বাঙালি হেনস্তা বন্ধের জোরালো দাবি উত্থাপন করে বাঙালিদের অধিকার সুরক্ষিত করে রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার দাবি তুলে সরকারের সন্দেহজনক ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন প্রায় সব বক্তা।
মেঘালয়ে বাঙালিদের উপর লাগাতার অত্যাচারের বিরুদ্ধে চরম হুঁশিয়ারি দিয়ে শীঘ্র নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানান বক্তারা। অন্যথায় সমগ্র বিশ্বের বাঙালি জনগণ নবরূপে চেতনা শক্তিতে জাগ্রত হয়ে মেঘালয়ের তথাকথিত জাতীয়তাবাদী খাসি ছাত্র সংস্থা ও মেঘালয় সরকারে বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হবেন তাঁরা। আমরা বাঙ্গালী-র অসম প্রদেশ কমিটির সচিব সাধন পুরকায়স্থ বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে লাগাতার বাঙালি জনগণের উপর বিভিন্নভাবে অমানবিক আক্রমণ সংগঠিত হচ্ছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে মেঘালয়ে অসংখ্য বাঙালির বসবাস ছিল। মেঘালয়ের উন্নয়ন ও বিকাশে বাঙালি জনগণের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। অবিভক্ত অসমের রাজধানী শিলং থাকাকালীন সমগ্র মেঘালয়ের কৃষ্টি সংস্কৃতি ও সামাজিক চিরাচরিত মেলবন্ধন তথা সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাঙালি মানুষের কৃতিত্বের ইতিহাস কখনও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু ১৯৭২ সালে মেঘালয় আলাদা রাজ্য হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে মেঘালয়ে বাঙালিদের উপর শারীরিক মানসিক, এমন-কি অর্থনৈতিক হেনস্তার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইদানীংকালে ইস্ট খাসি হিলসের ইছামতি, ভোলাগঞ্জ সহ বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে খাসি ছাত্র সংস্থা বাঙালি জনগণের উপর অত্যাচার অব্যাহত রেখেছে। এর পরিণাম ভয়ঙ্কর ধারণ করতে পারে বলে তীব্র আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন সাধন পুরকায়স্থ। আমরা বাঙ্গালী-র কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য অনিতা চন্দ, আজমল চৌধুরী, রণজয় দত্তচৌধুরী, কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতা সরিফুজ্জমান লস্কর, কাটিগড়ার প্রাক্তন বিধায়ক আতাউর রহমান মাঝারভুইয়াঁ, এআইইউডিএফ নেতা খলিল উদ্দিন মজুমদার, এনাম উল্লাহ, এআইউডিএফের কাটিগড়া বিধানসভা এলাকা ভিত্তিক কমিটির আতাউর রহমান লস্কর, এআইউডিএফ যুব ফ্রন্টের সভাপতি জিয়াউর রহমান, আইনজীবী নাসির আহমদ মিরা, ছাত্র সংস্থা আকসা-র উপদেষ্টা রূপম নন্দিপুরকায়স্থ, কালাইন ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের হুসেন আহমেদ, আমরা বাঙ্গালী-র ত্রিপুরা রাজ্যের কর্মকর্তা গোপাল দেব, জিরিবামের বাপ্পা রায়, এইচ এন মাহাতো, অসম প্রদেশ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অমল দাস, আমরা বাঙ্গালী-র কার্যকর্তা পার্থপ্রতীম দেব প্রমুখ আজকের বিক্ষোভ কর্মচূচিতে বক্তব্য পেশ করেছেন।
সরিফুজ্জমান লস্কর হুমকি দিয়ে বলেন, বাঙালি জনগণ মানবতার দৃষ্টিতে প্রতিবাদে হিংসাত্মক পথ বেছে নেয় না। কিন্তু অত্যাচার ও বঞ্চনার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বাঙালি জনগণ ক্ষেপে উঠলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই শীঘ্র বাঙালি জনগণের উপর অত্যাচার বন্ধ করে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ফিরিয়ে আনতে মেঘালয় সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সরিফুজ্জামান লস্কর। তিনি মেঘালয়ে বিগত দিনে বাঙালি জনগণের অধিকার সুরক্ষায় বিভিন্নভাবে সরব হয়েছিলেন বলেও জানান।
বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালি জনগণকে নির্যাতনের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সরকারের উদাসীনতার তীব্র সমালোচনা করেন কাটিগড়ার প্রাক্তন বিধায়ক আতাউর রহমানা মাঝারভুইয়াঁ। আজকের কর্মসূচিতে সশরীরে ছিলেন স্মাইল ফাউন্ডেশনের নিরুপম নাথ, জওহর পুরকায়স্থ, ধ্রুব মালাকার, মান্তু মালাকার, ত্রিশূল ফাউন্ডেশনের পূলক দাস, মৃণাল দাস, মহেশ দাস, বিট্টু দাস, প্রবীর দাস, আদিত্য দাস, সন্তোষ দাস, গৌরব দাস, চণ্ডীপুর যুব উন্নয়ন ক্লাবের সরজিৎ বৈষ্ণব, ভজন বৈষ্ণব, সুব্রত বৈষ্ণব, টিংকু বৈষ্ণব, অজয় বৈষ্ণব, জ্যোতিষ বৈষ্ণব, অঞ্জন বৈষ্ণব সহ অনেকে।
এদিকে মেঘালয়ে লাগাতার বাঙালি নির্তাতনের প্রতিবাদে আমরা বাঙালির আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন জানানোর পাশাপাশি নিউ মালিডহরে আলাদাভাবে ছয় ঘণ্টার ধরনা কর্মসূচি পালন করেছে কালাইন ও কাটিগড়া ব্লক কংগ্রেস কমিটি। সকাল আটটা থেকে বেলা দুটা পর্যন্ত এই আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। মেঘালয় সরকারের তীব্র সমালোচনা করে ধরনা কর্মসূচিতে বক্তব্য পেশ করেছেন কালাইন ব্লক কংগ্রেস সভাপতি বিশাল সরকার, উপ সভাপতি জাকির হুসেন খান, কালাইন জিপি সভাপতি মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, ভৈরবপুর জিপি সভাপতি দ্বীপন রায়, কাটিগড়া ব্লক কংগ্রেস সভাপতি হুসেন আহমদ চৌধুরী, জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক বিশ্বজিৎ মালাকার প্রমুখ।
পরে মেঘালয়ে বাঙালি নির্যাতন বন্ধের দাবিতে কাছাড়ের জেলাশাসকের উদ্দেশ্যে কাটিগড়ার সার্কল অফিসার প্রাণজিৎ দেবের কাছে এক স্মারকপত্র তুলে দেন কংগ্রেসের নেতা কর্মীরা। এদিনের উভয় আন্দোলনস্থলে মেঘালয়ে বাঙালি নির্যাতনের বিরুদ্ধে কড়া আওয়াজ তোলা হয়। প্রয়োজনে বিশ্বের সব স্থানের বাঙালি জনগণ সংঘবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে রণকৌশল গ্রহণ করবে বাঙালি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জনগণ। ইদানীংকালে মেঘালয়, মিজোরাম ও মণিপুরে বাঙালি হেনস্তার প্রতিবাদে দুনিয়ার বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানান সব বক্তা।
আমরা বাঙ্গালী-র মঙ্গলবারের বিক্ষোভ আন্দোলনে সরাসরি সমর্থন করেছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দিগরখাল সমাজ উন্নয়ন সংস্থা, দিগরখাল যুবশক্তি ক্লাব, কালাইন ট্রাক ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশন, কুশিয়ারকুল স্মাইল ফাউন্ডেশন, ত্রিশূল ফাউন্ডেশন, চণ্ডীপুর যুব উন্নয়ন ক্লাব, কালাইন কৃষক ক্লাব, ভৈরবপুর রবিজ্যোতি ক্লাব, আকসা ছাত্র সংস্থা, এআইইউডিএফ, কংগ্রেস সহ অন্যান্য সংগঠন।